ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানে চড়া এবং ভাগ্যবান ভ্যানচালক!

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানে চড়া এবং ভাগ্যবান ভ্যানচালক!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে-মধ্যেই টুঙ্গিপাড়ায় যান, কেননা এটা তার পূর্ব পুরুষের গ্রামই শুধু নয়, এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই কখনও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বা কখনও ব্যক্তিগত সফরে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে থাকেন। তবে সম্প্রতি টুঙ্গিপাড়ার সফরটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি একান্তই ব্যক্তিগত অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে এবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের নিয়মিত অবকাশ যাপনের সুযোগ আছে। সরকারপ্রধান দেশ পরিচালনা এবং জনগণের অভিভাবক হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করলেও তাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন আছে। ফলে অন্য সবার মতো তাদেরও নিয়মিত ছুটি বা অবকাশ কাটানোর সুযোগ থাকে। অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারপ্রধানরা এই সুযোগ নিয়মিত পেলেও আমাদের দেশের সরকারপ্রধানের এমন সুযোগ খুব একটা হয়ে ওঠে না। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মনে হয় আমাদের দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। প্রায় সর্বক্ষেত্রে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পাহাড় সমান সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে দেশ ও জাতির উন্নতি করার লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব বিশ্বের খুব কম সংখ্যক সরকারপ্রধানই পালন করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি এবার টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছেন এবং স্বচক্ষে মাটি ও মানুষের অবস্থা দেখার জন্য সেখানকার এক ভ্যানে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়া যাবেন, সেখানে অবকাশ যাপন করবেন এটা প্রত্যাশিত হলেও তিনি গ্রামের গরিব মানুষের বাহন ভ্যানে চড়ে ঘুরবেন তা মানুষের কল্পনাতীত ছিল। এমনিতেই প্রধানমন্ত্রী দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা খুব দরদ দিয়েই উপলব্ধি করেন এবং সেজন্যই তিনি দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ভ্যানে চড়ে সরেজমিনে দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাকে আরও অধিকহারে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প গ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ইমাম শেখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভ্যানে চড়িয়ে ঘুরানোর কারণে শুধু ধন্যই হয়নি, সেইসঙ্গে তার ভাগ্যও খুলে গেছে। এই ঘটনার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী তাকে নিয়ে গেছে পুনর্বাসনের জন্য। হয়তবা বিমানবাহিনী তাকে যোগ্যতা অনুযায়ী কোন পদে চাকরি দেবে, নতুবা তাদের দ্বারা পরিচালিত অন্য কোন প্রকল্পে কাজের সুযোগ করে দেবে। এর ফলে ভ্যানচালক ইমাম শেখের ভাগ্য খুলে যাবে এবং তার পরিবারেও কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে। সারাজীবন সাধনা করে সে যা করতে পারত না, তা সে একদিন প্রধানমন্ত্রীকে কিছুক্ষণ তার ভ্যানে চড়িয়েই পেয়ে গেছে। ইমাম শেখ ও তার হতদরিদ্র পরিবারের যে অবস্থা তা দেশের লাখ লাখ ভ্যান চালকেরই প্রতিচ্ছবি। কেউ শখ করে বা যার ন্যূনতম উপায় আছে সে কখনও দেহ মাটি করে রিক্সা বা ভ্যান চালায় না। একেবারে নিরুপায় হয়েই যখন কিছু করার থাকে না তখন এক রকম বাধ্য হয়েই তার নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দু’মুঠো অন্ন যোগানোর প্রয়োজনেই ভ্যান বা রিক্সা চালানোর মতো পেশা বেছে নেয়। এই ব্যবস্থাকে বলা যায় পেটের দায়ে আত্মকর্মসংস্থানের এক অভিনব পন্থা। শুধু ভ্যান বা রিক্সা চালকই নয়, দেশে বিভিন্ন ধরনের আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত রয়েছে কোটি কোটি কর্মক্ষম মানুষ। ছোট ছোট চায়ের দোকান, খাবার দোকান, মুদি দোকান, গরু-ছাগল পালনসহ হরেকরকমের আত্মকর্মসংস্থানের পথ কিছুটা বাধ্য হয়েই বেছে নিয়েছে দেশের বিশাল এক দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এজন্য তারা কোনরকম সরকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য-সহযোগিতা পান কিনা তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এই আত্মকর্মসংস্থানের উপায় যে এক রকম প্রয়োজনের তাগিদে এবং কিছুটা স্বউদ্যোগেই গড়ে উঠেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আর এই ব্যবস্থার প্রয়োজনও রয়েছে যথেষ্ট। আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির যে ধারাবাহিক উন্নতি এবং দারিদ্র্যসীমার হার যে অনেক কমে এসেছে তার পেছনে এই আত্মকর্মসংস্থানের রয়েছে বিরাট অবদান। এ কথা আজ প্রমাণিত যে, আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপক প্রসার ছাড়া কোন দেশেরই সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কথাটা উন্নত এবং অনুন্নত সকল দেশের বেলায়ই সমভাবে প্রযোজ্য। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্বও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটাকে উৎসাহিত করার জন্য নানারকম আর্থিক ও কৌশলগত সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে থাকে। আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশের জন্য এই আত্মকর্মসংস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। এত বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাই আত্মকর্মসংস্থানের কোন বিকল্প নেই। একজন পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদের একটি লেখায় পড়েছিলাম যে, বর্তমানে এমারজিং মার্কেটের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ) অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে আত্মকর্মসংস্থান। আমাদের দেশে এই আত্মকর্মসংস্থানের এক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই প্রতিটা কর্মক্ষম মানুষ স্বউদ্যোগে কোন না কোন কাজে নিয়োজিত আছে। কেউ বসে নেই। সুতরাং এই সুযোগ আর নতুন করে সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। ব্যাপক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রয়োজন শুধু এই বিশাল আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগকে সুসংহত এবং সুশৃঙ্খল করা। আত্মকর্মসংস্থানের একটা বড় অসুবিধা হলো যে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সেই সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অর্থ ধার করে কোন কাজ শুরু করার ফলে সেই ধারের টাকা পরিশোধের জন্য সার্বক্ষণিক এক চাপে থাকতে হয়। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য অন্নের যোগান দেয়া এবং একটু বেশি অর্থ হাতে আসা মাত্র অপ্রয়োজনীয় ফুর্তি করে অর্থের অপচয় করার কারণে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তি সঠিকভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করতে পারে না। তাদের সে যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা কোনটাই থাকে না। ফলে সেই কাজে নিয়োজিত থাকাকালীন যথাযথভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ, প্রয়োজনীয় সঞ্চয় এবং বিকল্প মূলধন এর কোনটাই ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। এতে করে ভবিষ্যতে প্রয়োজনের মুহূর্তে পেশাকে সচল রাখার জন্য পুনর্বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বা প্রয়োজনে বিকল্প কর্মসংস্থান শুরুর সময় তারা আর অর্থের যোগান দিতে না পেরে অনেকেই পুনরায় বেকারত্বের খাতায় নাম লেখায়, যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের অধিকাংশ কাজ কায়িক পরিশ্রমের, যা একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই সেই বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর যাতে বেকার বা অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল হতে না হয় তারও একটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা প্রতিটা ব্যক্তির আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকাকালীন সময়ে তার উপার্জন থেকেই করা প্রয়োজন। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগকে আরও বেশি প্রসারিত, সুসংহত এবং সুশৃঙ্খল করা প্রয়োজন, যাতে করে এই সুযোগটি যথেষ্ট টেকসই হয় এবং অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। আমার জানা মতে চীন এইদিকে দারুণভাবে অগ্রসর হচ্ছে। এ ব্যাপারে চীন নোবেল বিজয়ী আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে তাদের দেশের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগকে আরও প্রসারিত, সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করার দায়িত্ব দিয়েছে। কারণ, সেই অধ্যাপকের এই আত্মকর্মসংস্থানের ওপর রয়েছে অনেক গবেষণা। বাংলাদেশ সরকারেরও এখন এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের সময় এসেছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই স্বউদ্যোগী ও স্বপ্রণোদিত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাকে সুশৃঙ্খল করতে গিয়ে কোনরকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে দিয়ে যেন নতুন করে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি না হয়। আমরা আশা করব বাংলাদেশের কোন সংস্থা বা সরকার এই অগ্রসরমান আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগকে আরও বেশি প্রসার, সুসংহত এবং সুশৃঙ্খল করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। তা হলেই ভ্যানচালক ইমাম শেখের মতো আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষের ভাগ্যও খুলে যাবে। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
×