ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রলয়ের বাকি আড়াই মিনিট মাত্র!

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রলয়ের বাকি আড়াই মিনিট মাত্র!

পপুলিজম শব্দটি ইদানীং খুব ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে রাজনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান, ব্রেক্সিট গণভোটের পর ব্রিটেনে নাইজাল ফারাজ, তুরস্কে এরদোগোন এবং ভারতের নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্বের চেহারা। এই পরিবর্তনের ধারাকে অভিহিত করা হচ্ছে নব্য রাজনৈতিক মতবাদ (!) পপুলিজমের উত্থান হিসেবে। ইংরেজী শব্দটির বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে লোকরঞ্জনবাদ হিসেবে। আদৌ সুপ্রযুক্ত কী? কেননা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, লোকরঞ্জনবাদের সঙ্গে এক ধরনের ইতিবাচক ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ-বিনোদন, মনোরঞ্জনের সমূহ বিপদের ঝুঁকি জেনেও বলা যায়, জনসাধারণের সম্মিলিত ইচ্ছাকে সর্বদাই অবজ্ঞা করা চলে না। যেমন, ভারতের তামিলনাড়ুতে ষাঁড়ের লড়াই জাল্লিকাট্টু অর্ডিন্যান্স নিয়ে চলমান বিতর্ক ও মুখোমুখি অবস্থান। তবে রাজনীতিতে যখন পপুলিজম শব্দটি হামেশাই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, তখন এর নেতিবাচক প্রবণতাই, যা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক হতে পারে, পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আর এটাই হলো পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদের বিপদ। আপাতদৃষ্টিতে পপুলিস্ট নেতাদের গণতন্ত্রের দাবিদার অথবা প্রবক্তা হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। তবে বাস্তবে তারা কতটা গণতন্ত্রপন্থী কিংবা কতটা গণতন্ত্রবিরোধী, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক জানওয়ানার মুলার তার সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তক হোয়াট ইজ পপুলিজম গ্রন্থে এই বিপদ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তার মতে, ‘পপুলিস্টরা রাজনীতিকে জনগণের আরও কাছে নিতে চায় বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কায়েম করতে চায় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার চেয়ে ভ্রান্ত আর কিছু হতে পারে না। পপুলিস্টরা দাবি করে যে, একমাত্র তারাই জনগণের ইচ্ছার কথা ভাবে ও বলে। কিন্তু বাস্তবে জনগণ নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করবে, এমন একটা খোলামেলা উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় মোটেও আগ্রহী নয়।’ মুলার বলেন, পপুলিস্টরা আসলে এলিটদেরই একটা ভিন্ন গ্রুপ, যারা রাজনৈতিক বিশুদ্ধতার কথা বলে একটা ফ্যান্টাসি তৈরি বা ধোঁকাবাজির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চেষ্টা করে ক্ষমতা দখলের। তবে পপুলিজমের সবচেয়ে যুতসই সংজ্ঞা দিয়েছেন ভ্যাটিকান সিটির সর্বাধিকারী রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। তিনি সচরাচর রাজনীতি বিষয়ে কোন বক্তব্য দেন না। তবে গত কয়েক বছরে পরিবর্তন এসেছে সেখানেও। যেমন, যাজকদের বিয়ে, নারীর গর্ভপাত, জোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এবং ডারুয়িনবাদ সম্পর্কে ক্রমশ লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে ভ্যাটিকান। পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়েও ইদানীং তারা সোচ্চার। তো এহেন পোপ ফ্রান্সিস লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজমের উত্থানের বিষয়ে রীতিমতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। জনসাধারণের আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে গঠিত সরকার তথা লোকরঞ্জনবাদের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এতে নব্য হিটলারের জন্ম হতে পারে। স্পেনের পত্রিকা এল পাইসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, পপুলিস্ট সরকার বা রাজনীতি সমর্থনের মধ্যে হিটলারের মতো স্বৈরাচারীর উত্থানের ঝুঁকি থাকে।... এটি আতঙ্কের। তার মতে, ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে পপুলিজমের উত্থানের বিষয়টি ছিল এর একটি সর্বনাশা বড় উদাহরণ। ওই সময় ভেঙে পড়েছিল জার্মানি। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তখন মানুষ খুঁজছিল একজন নেতা। এ্যাডলফ হিটলার নামের এক তরুণ এসে বলল, ‘আমি পারব, আমি পারব’। জার্মানরা সেই হিটলারকে ভোট দিল। সে কিন্তু ক্ষমতা দখল করেনি। জনগণ তাকে ভোট দিয়েছিল এবং কয়েক বছরের মধ্যে সেই জনগণকেই সে ধ্বংস করে দিল।... সচেতন পাঠক বিলক্ষণ জানেন যে, জন্মসূত্রে হিটলার জার্মান ছিলেন না, বরং তিনি একজন অস্ট্রিয়ান। তো সেই জার্মানিতে এখন কী হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পরদিনই জার্মানিতে ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী নেতারা বৈঠক করেছেন। সেখানে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিন লো পেন বলেছেন, পশ্চিমাদের ভবিষ্যত নীতি হবে দেশপ্রেম। তার মানে কী, এতদিন তাদের দেশপ্রেম ছিল না? তিনি বলেন, চলতি বছর ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে যে নির্বাচন হবে, সেখানে জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। এই তিন দেশেই ক্ষমতায় আসবে জাতীয়তাবাদীরা। ২০১৭ সালকে তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপিয়ানদের জাগরণের বর্ষ’। নেদারল্যান্ডসের ফ্রিডম পার্টির প্রধান কট্টর মুসলিমবিরোধী ও অভিবাসনবিরোধী নেতা গিয়ার্ট ভিন্ডার্স বলেন, ‘গতকাল নতুন এক আমেরিকা, আজ... নতুন এক ইউরোপ...’। ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী নেতাদের অভিবাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী কথাবার্তা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ মূলত পপুলিজমেরই উত্থান বলে বিবেচিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নাম করা যায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান, ব্রিটেনের ইউকে ইন্ডিপেন্ডেস পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ, ভারতের বিজেপি নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রমুখের। যেমন, শপথ গ্রহণের পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে সবকিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে সংরক্ষণবাদ, জাতীয়তাবাদ ও লোকরঞ্জনবাদ। তিনি যে আমেরিকা ফার্স্ট, আমেরিকা শ্রেষ্ঠ ইত্যাদির মাধ্যমে বাগাড়ম্বরপূর্ণ অহংসর্বস্ব বক্তব্য রাখছেন, তাতে মূলত উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদেরই প্রতিফলন ঘটছে। বরং বহুধাবিস্তৃত, বহুধাবিভক্ত, বৈচিত্র্যপূর্ণ, বহুত্ববাদী মত ও পথ, যা মুক্তচিন্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রধান প্রাণশক্তি, তা আদৌ পরিস্ফুটিত হচ্ছে না। ট্রাম্পের হাত ধরে এই আমেরিকা বিশ্বের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠছে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। শপথ গ্রহণের পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন নিয়মনীতি ও আইন বিভাগের পরামর্শের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অধ্যাদেশ ও ডিক্রি জারি করে চলেছেন, যা কেবল একজন স্বেচ্ছাচারী একনায়ককেই মানায়। এটা এমন কি মার্কিন গণতন্ত্র, মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের সঙ্গেও মানানসই নয়। প্রায় প্রতিদিনই তিনি এমন কিছু করছেন নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে যা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বৈশ্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা-স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যও রীতিমতো হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সাতটি আরব দেশ- ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়া ও সোমালিয়া থেকে বিশেষ করে মুসলিম নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা দেয়ার ব্যাপারে কঠিন কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। দ্বিতীয়ত, সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু গ্রহণের ব্যাপারে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ। অবশ্য এ নিয়ে আদালতসহ তুলকালাম কা-কারখানা শুরু হয়েছে, যার রেশ গড়াবে বহুদূর। অন্যদিকে, যেসব দেশে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও স্বার্থ রয়েছে, যেমন সৌদি আরব, মিসর, জর্দান, সেসব ক্ষেত্রে আদৌ কোন কড়াকড়ি নেই। অথচ কে না জানে যে, মধ্যপ্রাচ্য সংকট, যুদ্ধাবস্থা ও চরম অস্থিতিশীলতার মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ ন্যাটোর আগ্রাসী ভূমিকা। অবশ্য ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং বলেছে, অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে তারাও সে দেশে মার্কিনীদের প্রবেশে আরোপ করবে নিষেধাজ্ঞা। অনুরূপ ইটের বদলে পাটকেল মেরেছে মেক্সিকো। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকোর সুবিস্তৃত সীমান্তে নিরেট দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। মামা-বাড়ির আবদার হলো, দেয়াল নির্মাণের খরচ দিতে হবে মেক্সিকোকে! দেশটি তা দিতে অস্বীকার করায় ট্রাম্প প্রশাসন শর্ত দিয়েছে যে, মেক্সিকো থেকে সব রকম আমদানিকৃত পণ্যে ২০ শতাংশ করারোপ করা হবে এবং কর দিতে হবে ম্যাক্সিকানদের, যারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে ও টাকা পাঠায় সে দেশে। মেক্সিকো সরাসরি এই সিদ্ধান্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে এবং তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হিসেবে সে দেশের প্রেসিডেন্ট এনরিকে পেনিয়ার বাতিল করেছেন ওয়াশিংটন সফর। তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরসহ গাজায় নতুন করে ইহুদী বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে ট্রাম্প প্রশাসনের নমনীয় ভূমিকা অচিরেই মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে তুলতে পারে। ক্ষমতা গ্রহণের পর মাত্র সাতদিনেই ট্রাম্পের এত সব গণবিরোধী ও শিশুসুলভ কার্যকলাপ দেখে ডুমসডে ক্লক বা প্রলয় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর এর সঙ্গে যুক্ত একদল মার্কিন বিজ্ঞানী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট। ১৯৪৭ সালে এরাই তৈরি করে ভুমসডে ক্লক। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরমাণু অস্ত্র নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণে সর্বশেষ ২০১৬ সালে এই ঘড়ির কাঁটা ১২টা বাজার তিন মিনিট আগে সেট করা হয়। প্রতীকী অর্থে প্রলয় ঘড়িতে যখন ১২টা বাজবে অর্থাৎ মধ্যরাত্রি, তখন বিশ্বে শুরু হয়ে যাবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, যাকে বলে কেয়ামত। বিশ্ব যখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে, তখন এই ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেন এটির তত্ত্বাবধানকারী বিজ্ঞানী দল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাগলাটে কর্মকা-, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্রমাবনতি, পপুলিজম তথা উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান, সর্বোপরি অস্ত্রসম্ভার বৃদ্ধির কারণে আপাতত প্রলয় ঘড়ির কাঁটা ৩০ সেকেন্ড এগিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ, প্রধানত ট্রাম্পের কারণে প্রলয় ধ্বংসের কাঁটা রাত ১২ টা বাজার মাত্র আড়াই মিনিট আগে এসে থমকে দাঁড়াল ডুমসডে ক্লক!
×