ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টেকসই উন্নয়নের শত্রু আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

টেকসই উন্নয়নের শত্রু আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি

বাংলাদেশের মানুষ কি সুখী? এখানে কি ব্যবসা করতে প্রচুর বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়? অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর পেতে এখন আর মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। দেশী-বিদেশী নানা সংস্থা, বিশেষ করে বিদেশী সংস্থার নানা জরিপ ও গবেষণায় একদিন আমরা আমাদের ওপর খবর পাচ্ছি, পাচ্ছি তথ্য ও পরিসংখ্যান। বস্তুত আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর বিদেশীদের তীক্ষè নজর। তারা সবকিছুর ওপর ‘আপডেট’ দিচ্ছে, আর আমরা পাচ্ছি। তাদের এ উৎসাহ জানার এ আগ্রহ আমাদের স্বাধীনতার পর পর ছিল না। বিদেশীদের ধারণা ছিল পাকিস্তান থেকে ‘বেরিয়ে’ এলে আমরা ‘উপোষ’ করে মরব। পাট, চামড়া ও চা দিয়ে আমাদের ‘সংসার’ চলবে না। তারা তো একপর্যায়ে বলেই দিল বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সে অবস্থা আজ আর নেই। পাট, চা ও চামড়া রফতানি করে আমাদের চলতে হয় না। যে পাকিস্তানের সঙ্গে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন, সে পাকিস্তানের ‘রুপী’র অবস্থা কী, আর আমাদের ‘টাকা’র অবস্থা কী তা সকলেরই জানা। এমনকি যে ভারতীয় ‘রুপী’র সঙ্গে ‘হুন্ডি’-তে আমাদের টাকার বিনিময়হার ছিল মাত্র ৩৮-৪০ টাকা, তা এখন ৮২-৮৪ টাকা। টাকার এ শক্ত অবস্থান, পাকিস্তান ও ভারতের ‘রুপী’র বিপরীতে টাকার শক্ত মান ও শক্তিটা এমনিতে হয়নি। এর জন্য আমাদের নিরন্তর চেষ্টা করতে হয়েছে। তিন-চার-পাঁচ শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার থেকে ছয় শতাংশে উন্নীত হতে এবং ছয় শতাংশের উপরে তা ধরে রাখতে আমরা সমর্থ হয়েছি। প্রায় এক দশক যাবত বাংলাদেশ ছয় শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এবং তা এ সরকারের আমলেই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এখন অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলছেন তা সাড়ে ৭ শতাংশ হবে। আমরা সফলতার সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) প্রায় সবগুলোই অর্জন করেছি। উন্নয়ন বলতে শুধু ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি নয়, উন্নয়ন বলতে বোঝায় সকলের জন্য উন্নয়ন। দারিদ্র্য হ্রাস, নির্মল পানীয়জল, স্নানাগার ইত্যাদিরও দরকার। দরকার শিক্ষার সুযোগ ও বাসস্থান। এসব ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রচুর ‘রেমিটেন্স’ বিদেশ থেকে আসছে। এসব দেখে এবং শুনে বিদেশীরা রীতিমতো বিমোহিত। তারা বলছে বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। অবশ্যই এর কারিগর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশকে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিকভাবে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন এক শান্তির দেশ হিসেবে, অনুকরণীয় দেশ হিসেবে। এখন আমাদের সামনে নতুন কাজ, নতুন চ্যালেঞ্জ। ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের পর এখন জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত কাজ ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’। অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। এতে আছে ১৭টি ‘অভীষ্ট’ এবং ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। সুকঠিন কাজ। এ কাজ সমাধা করা, এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এখন কাজ চলছে সর্বত্র। পরিকল্পনা কমিশন ব্যস্ত, ব্যস্ত অর্থ মন্ত্রণালয়। ঘন ঘন সভা হচ্ছে। ‘রূপকল্প-২০২১’ তো আছেই। রয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০১০-২০২১। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে চলছে। কথা হচ্ছে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির। আমরা সাত-সাড়ে সাত শতাংশে সন্তুষ্ট নই। দুই বছরের মধ্যেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার করতে হবে ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে কোন ছাড় নেই। বিনিয়োগকে নিতে হবে উঁচুমাত্রায়। ২৮ শতাংশের মতো আছে। এটি বাড়াতে হবে ৩০-৩২ শতাংশে। বাড়াতে হবে বেসরকারী বিনিয়োগ। শিল্পের অবদান ‘জিডিপি’-তে বৃদ্ধি করতে হবে ২০ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। এসবই ঠিক আছে। কিন্তু এসবের মাধ্যমে জীবনধারণের মানকে গুণগতভাবে সমৃদ্ধ করতে হবে। মানুষের শুধু দুই বেলা ভাত নয়, দরকার তার পুষ্টি; যা এখন নেই। পুষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা হচ্ছে ভালই। কিন্তু বিএ পাস ছেলেমেয়ে চিঠি লিখতে পারে না। ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকা- নেই। অতএব শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে, ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটাতে হবে। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার পর পরীক্ষা বৃত্তে তারা আটকে না থাকে। শতভাগ শিশুর পুষ্টির দরকার হবে। শতভাগ মানুষের সুপেয় জল লাগবে। তার ব্যবস্থা করতে হবে। শতভাগ মানুষের বিজ্ঞানসম্মত পয়ঃব্যবস্থার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরুষ-মহিলার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের বৈষম্যসহ সকল ক্ষেত্রের বৈষম্য দূর করতে হবে। এ ধরনের ১৬৯টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ। সকল দেশ তা মেনে নিয়েছে। আমরাও মেনে নিয়েছি। এখন প্রশ্ন- কোন্ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে এসব লক্ষ্য পূরণ করা হবে? এ বিষয়টি তো পরিষ্কারই। বাজার অর্থনীতি বা মার্কেট ইকোনমির অধীনেই তা হবে। থাকবে কার্যকর অবাধ বিশ্ব বাণিজ্য, উদারীকরণ। অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থা লাগবে, শ্রমের অভিবাসন দরকার হবে। পুঁজি অবাধে যাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এ ব্যবস্থাতেই আমরা ৩০ বছর যাবত চলছি। চলতে চলতে বেশ কিছুটা লাভবানও হয়েছি। দারিদ্র্য অন্তত বেশ কমেছে, যদিও সাড়ে চার কোটি লোক এখনও অনাহারে। এ পরিস্থিতিতেই এসেছে ‘টেকসই উন্নয়ন’-এর কথা। অর্থাৎ সকলের জন্য উন্নয়নের কথা। গোল বেধেছে এখানেই। প্রথম ‘গোল’ ‘ব্রেক্সিট’ এবং দ্বিতীয় গোল ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা বিজয়। দুটো ঘটনাই অবাধ বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর চপেটাঘাত। যুক্তরাজ্য তার নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষার জন্য ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ (ইইউ) থেকে বেরিয়ে এসেছে। আরও দু’-একটি দেশ তা অনুসরণ করতে পারে। এদিকে ট্রাম্প অবাধ বাণিজ্য চুক্তি-টিপিপি (ট্রান্সআটলান্টিক পার্টনারশিপ প্যাক্ট) বাতিল করেছেন। কয়েকটি দেশের অভিবাসন স্থগিত করেছেন। দক্ষ লোকদের ‘এইচ-ওয়ান’ ভিসার ওপর শর্তারোপ করেছেন। বলাবাহুল্য, এসবই অবাধ বাণিজ্যবিরোধী পদক্ষেপ। আরও এ ধরনের পদক্ষেপ তার ঝুলিতে আছে। প্রশ্ন : আমরা অবাধ বাণিজ্যের কিছুটা ফল ভোগ করছি। আমেরিকা যদি অবাধ বাণিজ্যের গতিরোধ করে বসে তাহলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে না কি? আমেরিকা আমাদের পোশাকের বৃহত্তম বাজার। বস্তুত ইউরোপ ও আমেরিকাই আমাদের পোশাকের ৯০ শতাংশের বাজার। তারা যদি অবাধ বাণিজ্য থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় তাহলে আমরা কী করব তার একটা অগ্রিম চিন্তা দরকার। বলাবাহুল্য, অবাধ বাণিজ্যের যে ফল আমরা পেয়েছি বা পাচ্ছি তা কিন্তু টেকসই উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক নয়। এর জন্যই তো টেকসই উন্নয়নের কথা উঠেছে। সম্প্রতি ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’-এর (ডব্লিওইএফ) যে সম্মেলন হয়ে গেল তাকে সামনে রেখে কয়েকটা ভয়াবহ বিষয় সামনে উঠে এসেছে। বিশ্বের সম্পদ ৮ জনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কোন কাজে আসছে না। ব্যবসায়ীরা কর দিচ্ছে না। তারা তাদের লাভ ‘পানামা’ জাতীয় দেশে রেখে দিচ্ছে। সাধারণ শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। তাদের প্রকৃত মজুরি বরং হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিযোগিতার নামে বড় বড় ব্যবসায়ী কোম্পানি রোবট ব্যবহারের দিকে যাচ্ছে। সস্তা শ্রমের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছে। এসব ঘোরতর প্রশ্ন, যা টেকসই উন্নয়নের শত্রু। আমরা কি এসব সমস্যা থেকে মুক্ত? যদি না হয়ে থাকি তাহলেই প্রশ্ন- এসব জঞ্জাল কী করে দূর করব? বাজার অর্থনীতি যে দানবের সৃষ্টি করছে এবং করেছে তা দূর করার ব্যবস্থা কী? আগামী দিনে কী করা হবেÑ সেই হচ্ছে এক কথা। আর আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি যেসব সমস্যা ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে তার সমাধান কী? দারিদ্র্য দূর হয়েছে- ঠিক কথা। কিন্তু দারিদ্র্য তো এখন আর দুই বেলা ভাতের অভাবকে বোঝায় না। দারিদ্র্য দূর করার অর্থ এখন আরও ব্যাপক। এসব কথাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে আছে। অতএব জরুরী কথা হচ্ছে ভবিষ্যতের কাজ ভবিষ্যত করবে, বর্তমানের জঞ্জাল দূর হবে কী করেÑ তাও আবার বাজার অর্থনীতির অধীনে। বাজার অর্থনীতি কী জিনিস এখন আর বুঝতে বাকি নেই। লোকের চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে কম। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কম। এরই মধ্যে যাদের চাকরি হয়েছে তাদের চাকরি যাচ্ছে প্রতিদিন। মতিঝিলে যান, খবর পাবেন। নতুন চাকরি পরের কথা। চাকরিওয়ালারাই যদি চাকরি হারায় তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? ‘লাইফ সার্ভিস’ বলে কিছু আর নেই। টেক কোম্পানিগুলো অস্থায়ী চাকরি তৈরি করছে। আজ চাকরি, বেতন ৫০ হাজার টাকা, কাল কর্মহীন, তাও মধ্যবয়সে; যখন ছেলেমেয়েরা ক্লাস ওয়ান-টুতে পড়ে। এ সমস্যার সমাধান করে ভবিষ্যতের কথা বলে লাভ হবে কি? বেতন-ভাতা-মজুরি অর্থাৎ প্রকৃত মজুরি দিন দিন কমছে। সরকারের তথ্যই এসব কথা বলছে। মূল্যস্ফীতি চলছেইÑ কম আর বেশি। একে ‘এ্যাডজাস্ট’ করার মতো মজুরি তো হচ্ছে না। ফলে লাখ লাখ মজুরের ভাগ্যে জুটছে বঞ্চনা। তার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত হচ্ছে। নিম্নবিত্ত গরিব হচ্ছে। কারণ তাদের আয় প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে। সুদের ওপর নির্ভরশীল অবসরপ্রাপ্ত ও বেওয়া-বিবিরা ভীষণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এসব তো টেকসই উন্নয়নের লক্ষণ নয়। এসব বকেয়া খাতায় রেখে ভবিষ্যতের কথা বলে কী লাভ? ব্যাংক মালিকানা চলে যাচ্ছে কয়েকটি পরিবারের হাতে। পাইকারি ব্যবসা, আমদানি ব্যবসা চলে যাচ্ছে বড়দের হাতে। ছোট ও মাঝারিরা মারা যাচ্ছে, ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে। কারা সব দখল করছে? কারা এসব বড় ব্যবসায়ী? তাদের বিরুদ্ধে লক্ষ অভিযোগ। তাদের সহায়-সম্পদ সব বিদেশে। এসব এখন আলোচনার বিষয়। বাজার অর্থনীতি এসব সমস্যার তৈরি করেছে। বৈষম্য এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। বস্তুত পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু সেসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন। আজ আমরা ফের ওই জায়গায় প্রত্যাবর্তন করেছি। এ সমস্যার মধ্যে টেকসই উন্নয়ন কিভাবে হবে? সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর পরিমাণ বৃদ্ধি তো ‘মলম’ লেপন মাত্রÑ এর দ্বারা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব কি? দয়া করে ইতোমধ্যে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধান করুন। আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি বন্ধ করুন। ওই অর্থনীতি চালু রেখে টেকসই উন্নয়ন হবে সোনার হরিণ। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×