ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে প্রকট কিডনিদাতা সঙ্কট, শত শত রোগী মরছে অকালে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দেশে প্রকট কিডনিদাতা সঙ্কট, শত শত রোগী মরছে অকালে

নিখিল মানখিন ॥ দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকল রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মৃত্যুর মুহূর্ত দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকছে না রোগীর স্বজনদের। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্য হ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দু’টি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে মঞ্জুরুল হাসানের। ডায়ালাইসিস দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দু’টি ডায়ালাইসিস ও ওষুধের পেছনে প্রতি সপ্তাহে খরচ লাগে প্রায় ১০ হাজার টাকা। জরুরীভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। মঞ্জুরুলের পিতা আব্দুল হাকিম হাওলাদার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। মা, ছোট তিন ভাই-বোন, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মঞ্জুরুল হাসানের সংসার। চিকিৎসার খরচ মেটানোর পেছনে ইতোমধ্যে সহায় সম্বল ফুরিয়ে গেছে। অসহায় হয়ে পড়েছে মঞ্জুরুল হাসানের পরিবার। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র গ্রামের ৩০ বছর বয়সী হাসান মিয়ার দু’টি কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। তার বড় ভাই হেলাল মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা যোগাড় করেছি। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ নিষিদ্ধ বলে জানিয়ে দিয়েছেন দেশের চিকিৎসকরা। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের কারও কিডনি মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশে অবাধ কিডনিদাতা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেই সব দেশে যেতে হলে আরও টাকা লাগবে। এভাবে চিকিৎসার নানা জটিলতায় পড়ে তাঁর ভাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান হেলাল মিয়া। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের রবিউলের চিকিৎসা। তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। জরুরীভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রবিউলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবাড়ি মহল্লার জিএম হিলালী রোডে। তিনি সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের অস্থায়ী ভিত্তিক পিয়নের চাকরি করেন। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল না। বর্তমানে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রবিউল ও সেলিনা পারভিনের সংসারে রয়েছে তিন সন্তান। চিকিৎসার পেছনে সহায় সম্বল ফুরিয়ে গেছে। এভাবে কিডনি বিকল হলেই রোগীর মৃত্যু যেন ঠেকানো যাচ্ছে না! দেশে কিডনির রোগী ২ কোটি ॥ দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। চিকিৎসা ব্যয় ॥ দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিসি ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালী জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনির পাথরের কারণে হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভাল দিক হচ্ছে, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ ॥ বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় কিডনি বিকল রোগীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৯৯ নামে রাষ্ট্রীয় গৃহীত একটি আইন আছে। ওই আইনে সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ নিষিদ্ধ। অপেক্ষাকৃত বেশি টাকার মালিকরা কিডনি বিকল রোগী বাঁচাতে অনাত্মীয় দাতা নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। যাদের টাকা নেই, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে দাতা নেই, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্মম মৃত্যু। কিডনি বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, আত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিডনি দাতার জেনেটিক্যাল সম্পর্ক যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, মামা, চাচা হতে হবে। রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু একই হলে ভাল হয়। কিডনি দাতার বয়স অবশ্যই ১৫ বছর উপরে এবং ৬৫ বছরের নিচে হতে হবে। ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৫’ ॥ অবশেষে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে (সংশোধিত) মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। মৃত ব্যক্তির বা তার উত্তরাধিকারের সম্মতিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফরম থাকবে। বর্তমান আইনে শুধু কারও জন্য উইল করে যাওয়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করার অনুমতি রয়েছে। তবে সংশোধিত আইনে সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধই থাকছে। মানব দেহের যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা তার বিনিময়ে কোন প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোন প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনরূপ প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৫’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা যা বলেন ॥ কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রয়োজনের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি দানে আইনী জটিলতা এবং আগ্রহী ব্যক্তির স্বল্পতার কারণে তা প্রতিস্থাপন অনেকাংশে আটকে আছে। ১৯৮২ সালে দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলেও নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫ কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, এর মধ্যে শিশুদের ১১। ২৯ বছরের হিসাবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মাত্র ১৭ বা প্রতি দুই মাসে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনিদাতার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্য হ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সংকট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। বিশিষ্ট কিডনি শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক এম এ সালাম বলেন, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে মৃত ব্যক্তির শরীরের মালিক রাষ্ট্র। মৃত ব্যক্তির কিডনি বা অন্য অঙ্গ তারা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। এ দেশেও এমন কিছু করা উচিত, যেন মৃত ব্যক্তির শরীরের কয়েকটি অঙ্গ প্রয়োজনে অন্যের শরীরে স্থাপন করা যায়।
×