ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবাসীদের আয় দেশের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের কর্মকৌশল নির্ধারণের চেষ্টা

রেমিটেন্স হ্রাসের কারণ খতিয়ে দেখতে কমিটি, প্রণোদনার চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রেমিটেন্স হ্রাসের কারণ খতিয়ে দেখতে কমিটি, প্রণোদনার চিন্তাভাবনা

এম শাহজাহান ॥ বৈধপথে প্রবাসীদের আয় দেশে আনতে রেমিটেন্সের ওপর বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হতে পারে। একই সঙ্গে তাদের এই আয় যাতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হতে পারে সে লক্ষ্যে কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে সরকার। রেমিটেন্স কেন কমছে তা খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। কমিটিতে রয়েছেন অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামসুন নাহার। শীঘ্রই কমিটি রেমিটেন্স হ্রাস সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে রেমিটেন্স আসে প্রায় ৯৬ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময় যা ছিল ১৩১ কোটি ডলার। এ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে শুধু এক মাসেই রেমিটেন্স ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৫ কোটি ডলার। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ডলার। আগের বছরে যা ছিল ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। এই হিসাবে রেমিটেন্স কমেছে ১৭১ কোটি ডলার। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ১১ শতাংশ। এছাড়া চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ৬১৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭৪৯ কোটি ডলার। ওই হিসেবে রেমিটেন্স কমেছে ১৩২ কোটি ডলার। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ১৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিটেন্স কমায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ রেমিটেন্স আহরণকারী ৩০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের (সিইও) নিয়ে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকেও রেমিটেন্স কমার পেছনে ছয় কারণ শনাক্ত করা হয়। কারণগুলো হচ্ছে-বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ধারাবাহিক পতন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা, পাউন্ড, ইউরো, রিংগিত ও সিঙ্গাপুর ডলারসহ অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান হ্রাস, ডলারের বিনিময় হার হ্রাস, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসা, প্রবাসী আয়ের উৎস দেশগুলোতে আইন-কানুন কঠোর হওয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানি ট্রান্সফার কোম্পানির ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়ায় প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্স প্রবাহের ওপর। এছাড়া অবৈধ পথে হুন্ডি আসা বেড়ে যাওয়াও রেমিটেন্স হ্রাসের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কেন কমছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনা দেয়া যায় কি না সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। প্রবাসীদের এই আয় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ আনার কর্মকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। বৈধপথে রেমিটেন্স আনা আকর্ষণীয় করা হবে। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে সরকার। ইতোমধ্যে কমিটি কাজ শুরু করেছে। জানা গেছে, সরকার ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক গঠন করে বিদেশ যাওয়ার ঋণ ছাড়াও ফেরত প্রবাসীদের জন্য রি-ইন্ট্রিগ্রেশন ঋণ চালু করেছে। ফলে চাকরি থেকে ফিরে আসার পর তারা চাইলে উপযোগী আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে পুঁজির যোগান পাবেন। তাছাড়া ওয়েজ আর্নারস বন্ড চালুর মাধ্যমে সরকারীভাবে প্রবাসীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজ শর্তে সেবা দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সরকারের আরেকটি উদ্যোগ প্রশংসনীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের প্রতিবছর পুরস্কার দিয়ে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে। এ ধারা চালু থাকলে প্রবাসীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে নিয়মিত রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হবেন। এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, শুধুমাত্র বেশি পরিমাণে অর্জিত রেমিটেন্সের প্রভাবে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রিজার্ভ দেখা যায়-যার আর্থিক মূল্য ছিল ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের ইকোনমিক আপডেট রিপোর্টে রেমিটেন্স কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে-যা অবহিত করা হয় প্রধানমন্ত্রীকেও। তিনি রেমিটেন্স কমার কারণ শনাক্ত করা এবং প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে রেমিটেন্স আনতে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ২৫০ কোটি টাকা দেয়ার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমানে এই ব্যাংকের মূলধন হচ্ছে ১শ’ কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী যেকোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিশোধ মূলধনের পরিমাণ হবে ৪০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে বৈধভাবে রেমিটেন্স কমেছে। সেটি মোকাবেলায় ব্যাংকটিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তরের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর কার্যক্রম শুরু করা হবে। এছাড়া অধিক পরিমাণ রেমিটেন্স অর্জন ও রেমিটেন্সকে টেকসই করতে ভারত সরকার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। শুধু ভারত কেন, বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যারা রেমিটেন্স আয়ের ওপর নির্ভরশীল তারাও এই খাতে সফলতা অর্জনে নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী ও তাদের পরিবারকে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বিষয়ে ধারণা দেয়া গেলে তারা উদ্বুদ্ধ হবে এবং রেমিটেন্সকে আয়মূলক কাজের ধারায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
×