ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ বই পড়ার বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ বই পড়ার বিকল্প নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭। বুধবার বিকেলে বাংলা একাডেমিতে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চীনের প্রখ্যাত গবেষক ও রবীন্দ্র-অনুবাদক ডং ইউ চেন, অস্ট্রিয়ার মেনফ্রেড কোবো, পুয়ের্তোরিকোর লুস মারিয়া লোপেজ, ভারতের চিন্ময় গুহ প্রমুখ। প্রকাশক-প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মফিদুল হক। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সকলকে বই পড়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাসার প্রায় সবারই বই পাঠের অভ্যাস আছে। এখন ডিজিটাল মাধ্যামে বই পড়ার অনেক সুযোগ হয়েছে। তার পরেও বইয়ের পাতা উল্টে বই পড়ার মজাই আলাদা। এ কারণেই আমি চাই প্রতিবছর আরও নতুন নতুন বই ছাপা হোক। বর্তমান প্রজন্মের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠুক। প্রধানমন্ত্রী দুঃখ করে বলেন, সরকারে আসার পর থেকে অনেক কিছুই আর করতে পারি না। ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাবাসের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা ছিল ছোট কারাগার। এখন যেন বড় কারাগারে আছি। অনেক কাজ। প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বইমেলায় আসতে পারি না। অনুবাদ সাহিত্যের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, অনুবাদ যত বেশি হবে ততই আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে অন্য দেশের সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটবে। আদান-প্রদান হবে। এটা খুব জরুরী। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের মতো বাংলার দামাল-দায়বদ্ধ তারুণ্য নিজেদের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে উচ্চারণ করেছে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার ও মর্যাদার কথা। স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকদের প্রবল পরাক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে সেদিনের বাঙালী তরুণরা সংগ্রামী শপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, মাতৃভাষার জন্য বেছে নিয়েছিল শাহাদাতের পবিত্র পথ। তাঁদের চরম আত্মত্যাগের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে বাংলা পেয়েছিল রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। বস্তুত ভাষা আন্দোলন শুরু হয় সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরইÑ ১৯৪৮ থেকে, যার প্রাথমিক পর্ব থেকেই নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একুশের পথ বেয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে যেমন ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানায় তেমনি সারা বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে গ্রন্থপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশ থেকে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি ইত্যাদি দূরীকরণে আমরা অনেকটাই সফলতা অর্জন করেছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-কাজ সম্পন্নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-সহ রাজনৈতিক হত্যাকা-সমূহের সুষ্ঠু বিচার বাস্তবায়ন করেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। সভাপতির বক্তব্যে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলা ভাষা-সাহিত্য গবেষণায় ও বাঙালী সংস্কৃতির অব্যাহত চর্চায় একাডেমি সম্প্রতি বহির্বিশ্বের গবেষকদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’, ‘বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান’, ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’, ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ এবং ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাস প্রকাশ করে একাডেমি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মধ্য দিয়ে একুশের দেশজ চেতনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মননবিশ্বের যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রকাশক প্রতিনিধি মফিদুল হক বলেন, গ্রন্থমনস্ক জাতি গঠন করতে প্রকাশনা-ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরকারঢ প্রণোদনা প্রয়োজন। প্রকাশনাশিল্পে বর্তমান বরাদ্দ বৃদ্ধি করে গ্রন্থশিল্পের কেন্দ্রস্থল বাংলাবাজারকে সম্প্রসারিত করা এখন সময়ের দাবি। শুভেচ্ছা বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ বলেন, একুশ আমাদের আলোক-চেতনার দিশারী, উজ্জ্বল বাতিঘর ও অনির্বাণ ধ্রুবতারা। সীমিত পরিসরে একুশ স্মরণে বইমেলা শুরু হয়ে আজ বাংলা একাডেমির আয়োজনে বিশাল ব্যাপ্তি লাভ করেছে, যা আমাদের পরম গৌরব ও আনন্দের বিষয়। স্বাগত ভাষণ প্রদান করে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশেরও কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে একুশের চেতনা আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এদিন গ্রন্থমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবি-সাহিত্যিকদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন সাতজন বিশিষ্ট কবি, লেখক এবং গবেষক। কবিতায় আবু হাসান শাহরিয়ার, কথাসাহিত্যে শাহাদুজ্জামান, প্রবন্ধ ও গবেষণায় মোরশেদ শফিউল হাসান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে ডা. এম এ হাসান, আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় নূরজাহান বোস এবং শিশুসাহিত্যে রাশেদ রউফ পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ড. নিয়াজ জামান অসুস্থ থাকায় পুরস্কার গ্রহণ করতে আসতে পারেননি বলে জানানো হয়। অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই তুলে দেয়া হয়। বাংলা একাডেমি তাদের প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি বিষাদ সিন্ধুর ইংরেজী অনুবাদ ‘ঙপবধহ ড়ভ ঝড়ৎৎড়’ি এবং হারুন-অর-রশিদের লেখা ‘মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬’ বই দুটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়। জার্মানি থেকে প্রকাশিত ‘ঐঁহফৎবফ চড়বসং ভৎড়স ইধহমষধফবংয’ এবং ক্রিস্টিয়ান কার্লসন অনূদিত সুইডিশ ভাষায় বাংলাদেশের কবিদের কবিতা সংকলন ‘ইবহমধষ ওংশধ গড়ষহ’ বই দুটিও উপহার দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীকে। একই দিন তিনি ৪ দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭’ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রন্থমেলা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
×