‘যতই পড়িবে ততই শিখিবে।’- অনেক বছর আগে যখন নিম্ন-মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ছিলাম তখন ক্লাসে স্যারদের কাছে এ কথাগুলো শুনতাম প্রায়শই। কিশোর বেলায় সীমিত ভাবনায় মনে করতাম শুধু পাঠ্যবই পড়ার জন্যই যেন কথাগুলো বলা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে পাঠ্য বইয়ের বাইরে যে বিশাল বইয়ের জগত তাই হচ্ছে এক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয়। এ জন্যই তো বিদ্যালয়গুলোতে লাইব্রেরি আছে, আছে বিভিন্ন ধরনের বইপত্র। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্্দীন, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রসহ অন্যান্য লেখকের বই পড়তে পড়তে পড়ার একটা নেশা যেন তৈরি হয়ে গেল মনে অক্লান্ত! সঙ্গে সঙ্গে একটা অন্য রকম ভাল লাগার অনুভূতি সারা মনজুড়ে! পরবর্তীকালে খবরের কাগজে প্রকাশিত সাহিত্যের পাতা এবং বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন পড়ার দিকে আগ্রহ তৈরি হলো। লাভ কি হলো? প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা বেড়ে গেল, এ ভাষার সাধু রীতি, চলতি রীতি আয়ত্ত হলো, ভাষার শুদ্ধ রূপ, শুদ্ধভাবে লিখতে পারা আর বলতে পারার সামর্থ্য অর্জিত হলো, কি মজা!
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় -১. মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে দেশের রাজপথ/মাটি শহীদের বুকের রক্তে রঞ্জিত সে দেশে এত নিরক্ষর কেন এখনও, শিক্ষিতদেরই (!) বা মাতৃভাষার প্রতি এত অবহেলা কেন? ২. শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না, সেভাবে যে হবে তার নিশ্চয়তাও মিলছে না! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প মাধ্যমিক পর্যায়ের ‘শিক্ষার্থী’দের জন্য পাঠাভ্যাস উন্নয়ন চালু করেছে -উদ্যোগটি আশাব্যঞ্জক অবশ্যই।
শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বইপত্র পড়তে হবে। এ ভাল অভ্যাস রপ্ত করে ভবিষ্যতে তারা সুবিবেচক, সহানুভূতিশীল, ধৈর্যশীল, মননশীল, আত্মবিশ্বাসী, বিনয়ী, সাহসী, দূরদর্শী, সূক্ষ্মদর্শী, পরিণামদর্শী, তাৎক্ষণিক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং সর্বোপরি আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে।
এখন মাঘ ১৪২৩, প্রমথ চৌধুরীর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বই পড়া’ শ্রাবণ ১৩২৫-এর থেকে কিছু উদ্ধৃত করলে ৯৮ বছর আগের সেই কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হবে এখনও :
‘আমার বিশ্বাস শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।’...আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্রে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়; প্রতি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্কুল-কলেজ বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে, সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য। লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়; তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল।’...
সুতরাং, বর্তমানে বিদ্যমান যে অবস্থা তার থেকে জরুরী প্রতিকার পাওয়ার উপায় বই পড়ার মধ্যেই খুঁজতে হবে। বিশেষত সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অধিকতর মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, একুশের বাইমেলা বই পড়ার অভ্যাস তৈরিতে এবং একই সঙ্গে মানুষকে ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
পাটোয়ারীপাড়া, পঞ্চগড় থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: