ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

ডোনাল্ড ট্রাম্প ॥ শঙ্কায় বিশ্ব রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ডোনাল্ড ট্রাম্প ॥ শঙ্কায় বিশ্ব রাজনীতি

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করে পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে পাখির চোখে তাকিয়ে সারা বিশ্ব। যে ঝড়ে তিনি পাল্টে দিয়ে ছিলেন প্রাক নির্বাচনী সব হিসাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার শুরুতেই ঝড়ের আশঙ্কা করছিল সংশ্লিষ্ট মহল। আর ট্রাম্পও হতাশ করেননি তাদের। হোয়াইট হাউসে প্রবেশের প্রথম ঘণ্টায় সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তুললেন বিতর্কের ঝড়। সেটি ছিল কেবল সূচনা। তার সর্বশেষ পদক্ষেপ বলা চলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যাওয়া। যা এই মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে। গত শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলাল্ড ট্রাম্প কথা বলেছেন তার রাশিয়ান প্রতিপক্ষ ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে। প্রায় এক ঘণ্টার দীর্ঘ ফোনালাপে তাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল সিরিয়াসহ বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুগে একসঙ্গে কাজ করা। হোয়াইট হাউস আর ক্রেমলিনে উভয় সূত্রই এই আলোচনাকে চিহ্নিত করছে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের উত্তেজনা হ্রাসে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে। তবে পুতিনের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সহযোগিতার গুরুত্ব অন্যত্র। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ইসলামিক স্টেটকে ওড়িয়ে দিতে ৩০ দিনের মধ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের আদেশ দিয়েছেন পেন্টাগণকে। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আইএস সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় তিনি আরও আগ্রাসী ভূমিকা নেবেন সেটাও স্পষ্ট এই আদেশে। যদিও ট্রাম্পের আদেশের পূর্বেই সামরিক পরিকল্পনাবিদরা ট্রাম্প ও ডিফেন্স সেক্রেটারি ম্যাটিসের বিবেচনার জন্য আইএস ধ্বংসের কার্যকরী পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইরাক ও সিরিয়া আরও সামরিক পরামর্শক নিয়োগ, স্থানীয় সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহী বাহিনীর আরও সন্নিকটে মোতায়েনসহ ফিল্ড কমান্ডারদের আরও অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাবও রয়েছে। আদেশ স্বাক্ষরের পূর্বে ট্রাম্প ওভাল অফিসে উপস্থিত কর্মকর্তাদের জানান, এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এবং আমি নিশ্চিত সাফল্যের বিষয়ে। ট্রাম্পের আইএসবিরোধী যুদ্ধে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশল নির্ধারক স্টিফেন কে বেনন। বলা হয় প্রশাসনে বেননের অবস্থান কেবল রাজনৈতিক নয় তার চাইতে বেশি কিছু। অন্য এক আদেশে অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে ট্রাম্প বেননকে পুনর্গঠিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে স্থায়ী সদস্য নিয়োগ করেন। যে কাউন্সিলে উর্ধতন সামরিক, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সেক্রেটারি অব ডিফেন্স এবং স্টেটও আছেন। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ট্রাম্প তার আদেশে জানান, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স বা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফরা কেবল অস্থায়ী সদস্য হিসেবে তাদের দায়িত্ব বা কাজের বিষয়ে আলোচ্যসূচীতে থাকলে তবেই কেবল প্রিন্সিপাল কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারবেন বা অনেকাংশেই সেনা, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি ট্রাম্পের অবিশ্বাসকেই চিত্রায়িত করছে। হোয়াইট হাউসের ধারণা এ ধরনের পরিবর্তন এনএসসির কাজে আরও গতি আনবে যে কোন হুমকি মোকাবেলায়। ট্রাম্প বলেন এ ধরনের পরিবর্তন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে করবে সুরক্ষিত। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে সামনে এলেন বেনন যিনি শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্ববাদী ওয়েবসাইট ব্রেটবার্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। যার উত্থান ট্রাম্পের রাজনৈতিক পরামর্শক হিসেবে। বেনন ইতোমধ্যেই উঠে এসেছেন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হিসেবে। উল্লেখ্য, ট্রাম্প-পুতিনের ফোনালাপের সময় বেনন উপস্থিত ছিলেন ওভাল অফিসে। ফোনালাপে ট্রাম্প-পুতিনের আলোচ্যসূচীতে ছিল ইউক্রেন ও সিরিয়া। তারা একমত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার অর্থনৈতিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে। ক্রেমলিনের বিবৃতিতে জানা যায় দুই সরকারপ্রধান ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক বৈঠকের ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। তবে পুতিনের মুখপাত্র ডিমিট্রি পেসকড জানান, দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে রাশিয়ার ওপর জারি করা ওবামা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উত্তোলনের বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। যদিও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মস্কোর প্রথম দাবি। অপরদিকে ট্রাম্প নিজ দেশে নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখা নিয়ে আছেন চাপের মুখে। গত শুক্রবারে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানান, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বিষয়টি বিবেচনার সময় এখনও আসেনি। হোয়াইট হাউসের মতে ট্রাম্পের কলটিকে সম্পর্কের নতুন যুগে প্রবেশের সূত্রপাত হিসেবে নিয়েছেন পুতিন। এই ইতিবাচক আলোচনা যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বৈরি সম্পর্কের ক্ষতে প্রলেপ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। হোয়াইট হাউসের মতে উভয় প্রেসিডেন্টই আশাবাদী যে এই ফোনালাপের পর উভয় দেশই যেমন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে তেমনি বিদ্যমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা সম্ভব। গত শনিবার পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ ছিল পাঁচ বিশ্ব নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের কথোপকথনের কেবল একটি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে ট্রাম্প কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মান ও জাপানের সরকারপ্রধানের সঙ্গে। তবে এও সত্য রিফিউজে বিষয়ে আর সাতটি মুসলিম দেশে ট্রাম্প প্রশাসনের নিয়ে ধাক্কা নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলেছে সে আলোচনায়। ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ স্পষ্ট জানিয়ে দেন। অধিবাসীদের স্বাগত জানানো যে ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের উচিত তার প্রতি সম্মান জানানো। দিনের শুরুটা ট্রাম্প করেন জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে। কথা বলেন পারস্পরিক নিরাপত্তা আর বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ে। আলোচনায় ছিল উত্তর কোরিয়ার হুমকি বলে হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা যায়। অ্যাবে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন সফরে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে সম্মতি জানান। পরবর্তী কলটি ট্রাম্প করেন জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মারকেলকে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ট্রাম্প রিফিউজি ইস্যা, ন্যাটো নিয়ে যেভাবে ধুয়ে দিয়েছেন জার্মান নেতাকে তাতে আলোচনায় উত্তেজনার ছোঁয়া থাকাটা স্বাভাবিক। তার পরও ট্রাম্প মারকেলের দাওয়াত কবুল করে জি-২০ সম্মেলনে জুলাইয়ে হামবুর্গে উপস্থিতির কথা জানান। পাশাপাশি ন্যাটোসহ পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়েও কথা বলেন। ট্রাম্প কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়া ও হল্যান্ডের নেতার সঙ্গে। হল্যান্ড পরিষ্কার জানিয়ে দেয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যারিস চুক্তি বজায় রাখা জরুরী। জবাবে ট্রাম্প বলেন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। মস্কোর ধারণা ওবামার চাইতে ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে নতুন গতি আসবে। যদিও বিরোধী দল তো বটেই ট্রাম্পের দলীয় আইন প্রণেতাদের অনেকেই ট্রাম্পের পথচলায় বিপদ সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন। ট্রাম্প এর মধ্যেই নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন নতুন লবিং আইন বিষয়ে। পেছনে দাঁড়ানো হোয়াইট হাউসের এইডরা হেসে ওঠেন যখন ট্রাম্প বলেন আমার পেছনে দাঁড়ানো বেশিরভাগ লোকেরই ক্ষমতা নেই এই মহান দেশের জন্য কিছু করার। ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন কিছু করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে। শুরুটা প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি নতুন আলো ফেলেছেন মার্কিন রাজনীতিতে। যে আলোয় কেবল তার স্বদেশীরা নয় বিশ্ব নেতারাও দেখার অপেক্ষায় মার্কিন রাজনীতির মোড় পরিবর্তন। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
×