ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক তারকা ফুটবলার-সাংবাদিকদের স্মৃতিচারণ, ফুটবল উন্নয়নে গঠনমূলক পরামর্শ ;###;জাহিদুল আলম জয়

মোহামেডানের জন্য মহাপাগল!

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মোহামেডানের জন্য মহাপাগল!

দেশী-বিদেশী সকল ক্লাবেরই সমর্থক দল থাকে। তাদের কাজই হচ্ছে, ব্যানার আর বাদ্য বাজনা নিয়ে মাঠে বসে খেলা দেখা এবং নিজ দলকে উৎসাহিত করা। তেমনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেরও বেশ কয়েকটি সমর্থক দল আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেছে ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দল ‘মহাপাগল’। যার অর্থ মোহামেডানের জন্য পাগল। ১৯৮০ সাল থেকে গড়ে উঠা এই সমর্থক দল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে এর ব্যাপক প্রসার এবং জনপ্রিয়তা। মহাপাগলদের মূল উদ্দেশ্য, নিজ দলকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি সাবেক এবং বর্তমান তারকা খেলোয়াড়দের সম্মান জানানো ও অতীতের খেলাধুলার স্মৃতি রোমন্থন করা। এ উদ্দেশেই মহাপাগল গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজন করে সাবেক সব তারকা ফুটবলারদের মিলনমেলা। যেখানে মূল প্রতিবাদ্য বিষয় ছিলÑ ‘ফুটবল জাগরণে মোহামেডানের বিকল্প নেই এবং স্বর্ণালী দিনের সাবেক তারকা ফুটবলারদের সম্মাননা প্রদান ও স্মৃতিচারণ’। ব্যতিক্রম এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এমন সব ব্যক্তিবর্গ, যারা একসময় (ষাট থেকে নব্বই দশক) ঢাকা ফুটবলের মাঠ কাঁপিয়েছিলেন। অর্জন করেছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। তাদের একেকজনের একেক বয়স, একেক পেশা। তবে সবার মধ্যেই একটি লক্ষ্যণীয় মিল আছে। তা হলো এদের সবাই ছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল দল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়। এদের অনেকেরই পরস্পরের সঙ্গে বহুকাল ধরে দেখা-সাক্ষাত বা যোগাযোগ নেই। এদের এক ছাদের নিচে জড়ো করার কাজটি করে মোহামেডান সমর্থক দল ‘মহাপাগল।’ অনুষ্ঠানে প্রিয় ক্লাব মোহামেডানের ব্যর্থতার জন্য সবাই আপসোস প্রকাশ করেন। পাশাপাশি দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন পরামর্শ রাখেন। ব্যতিক্রমী এই অনুষ্ঠানে মঞ্চে অতিথি হিসেবে ছিলেন মোহামেডানের গবর্নিং বডির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুনিরুল হক চৌধুরী, সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক মুহম্মদ কামরুজ্জামান, মোহামেডানের গবর্নিং বডির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল, চ্যানেল ২৪-এর ক্রীড়া সম্পাদক দিলু খন্দকার, দৈনিক জনকণ্ঠের ক্রীড়া সম্পাদক মজিবুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউর রহমান সোহাগ এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের উপ-সম্পাদক ও বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সভাপতি মোস্তফা মামুন। মহাপাগলের আহ্বায়ক ছিলেন নাজমুল আমিন কিরণ। আর পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মহাপাগলের প্রতিষ্ঠাতা টি ইসলাম তারিক। অনুষ্ঠানে স্বর্ণালী দিনের সাবেক তারকা ফুটবলারদের সম্মাননা স্মারক দেয়া হয়। বিশেষ সম্মাননা স্মারক পান জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, গোলাম সারোয়ার টিপু, কাজী মোঃ সালাউদ্দিন, হাসানুজ্জামান খান বাবলু, নওশেরুজ্জামান, অমলেশ সেন, রকিবুল ইসলাম, শেখ মোঃ আসলাম, আবু ইউসুফ, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, স্বপন দাস, আবদুল গাফ্ফার, আজমত, অলক, মনি, জনি, কায়সার হামিদ, ছাইদ হাসান কানন, খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল, মন্টু, মাহমুদুল হক লিটন, সাব্বির, মানিক, জুয়েল রানা, মনু, আরমান মিয়া, নাসের হেজাজী, এমেকা, আরিফুল হক প্রিন্স (হকি খেলোয়াড়), মনোয়ার মুন্না এবং প্রয়াত মোনেম মুন্না। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মোহামেডানের সাবেক ফুটবলার নকীব, আলফাজ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে মহাপাগলের অন্যতম সদস্য ফারুক আহমেদের মৃত্যুতে ‘ফারুক স্মৃতি সম্মাননা স্মারক’ দেয়া হয়। এ স্মারক পান মোহামেডান ফ্যান সবার প্রিয় ‘আতা ভাই’ ও মফিজ। সংগঠক হিসেবে পুরস্কৃত হন সিরাজুল হক চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সাবেক তারকারা স্মৃতির ডালি সাজিয়ে বসেন। সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। অতীত ও বর্তমান সময়ের ফুটবল নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকা মোহামেডানের অধিনায়ক ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার স্বপন দাস বলেন, ‘ফুটবলের এই ক্রান্তিলগ্নে মহাপাগলের এমন আয়োজন আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। একটা সমর্থক দলের ব্যানারে এমন আয়োজন ফুটবলের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।’ মোহামেডান ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক সাঈদ হাসান কানন বলেন, ‘অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে যেন অতীতে ফিরে গিয়েছি। এরকম আয়োজন সত্যি আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সঠিক পরিকল্পনা পেলে বাংলাদেশের ফুটবল নিশ্চিত খুব শীঘ্রই জেগে উঠবে।’ সাবেক জাতীয় ফুটবলার হাসানুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘অর্থ ব্যয় করলেই অনুষ্ঠান সুন্দর হবে এমনটা বলা যাবে না। মহাপাগল প্রমাণ করেছে তাদের রুচিবোধ অন্যান্য সমর্থক দলের চাইতে ভিন্ন।’ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আবু ইউসুফ বলেন, ‘আমি এই অনুষ্ঠানে এসে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মহাপাগল আমাদের যে সম্মান দিয়েছে আমরা ওদের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। খেলোয়াড়ী জীবনে অনেক অনুষ্ঠানেই গিয়েছি। কিন্তু মহাপাগলের এমন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। দেশে যে এখনও এমন ফুটবল পাগল আছে ভাবতেই অবাক লাগছে।’ আপসোসের সুরে ইউসুফ বলেন, ‘যখন খেলোয়াড় ছিলাম, তখন ফুটবল ক্রেজ এত বেশি ছিল যে, ঘর থেকে বেরই হতে পারতাম না। অথচ এখন সেই ফুটবল ক্রেজ বিস্মৃতপ্রায়। মোহামেডান-আবাহনীর মতো দলগুলোর ক্ষয়িষ্ণু ও হারানো জনপ্রিয়তা যেদিন ফিরে আসবে, সেদিন আবারও দেশের ফুটবল জেগে উঠবে। সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার আরমান মিয়া বলেন, ‘আমি মহাপাগলের অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তাদের চিন্তা চেতনা সত্যিই ব্যতিক্রম। ফুটবলের জন্য এমন ভালবাসা এই সময়ে বিরল।’ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, বাংলাদেশ জাতীয় দল ও মোহামেডানের সাবেক অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু বলেন, ‘মোহামেডানে একসময় খেলেছি। দলটির বর্তমান দুরবস্থা দেখে সাবেক ফুটবলার হিসেবে খুবই দুঃখ পাই।’ সাবেক ফুটবলার বাদল রায় বলেন, ‘মোহামেডানের ভাল সময়ে দলটির হয়ে খেলেছি। আজ দলটির করুণ অবস্থা দেখে খারাপ লাগে। রেলিগেশন এড়ানোর পর ক্লাবটির কর্মকর্তাদের উৎসব করা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাদের এই দুর্দিনে আবাহনীও লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরোপুরি খুশি হতে পারেনি। দলটির কর্মকর্তারা যেন ক্লাবটিকে বাঁচিয়ে তোলেন।’ মোহামেডান ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী এবং মোহামেডান ও জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় বাদল রায় ১০/১৫ দিনের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে মহাপাগলের প্রতিষ্ঠাতা টি ইসলাম তারিক স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমাদের অনুষ্ঠান ছিল স্বর্ণালী দিনের তারকা ফুটবলারদের সম্মাননা প্রদান এবং স্মৃতিচারণ। সমর্থক দল আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মনিরুল হক চৌধুরী ও বাদল রায় তাদের ব্যক্তিগত মতপ্রকাশ করেছেন। মহাপাগল সমর্থক দল কখনই কোন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না বা থাকবেও না। মহাপাগলের ধ্যান ধারণা অন্যান্য সমর্থক দলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।’ স্মৃতিচারণ করে মহাপাগল প্রতিষ্ঠাতা আরও বলেন, ‘১৯৮০ সালে মোহামেডান-ব্রাদার্স ম্যাচ দিয়ে আমার খেলা দেখা শুরু। মোহামেডানের জার্সি দেখেই ক্লাবটির প্রেমে পড়ি। সে বছরই প্রতিষ্ঠা করি মহাপাগল। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দল। মোহামেডানে অনেক ফুটবলার আছেন, যারা দলকে অনেক শিরোপা এনে দিয়েছেন। তারা দেশকেও অনেক কিছু দিয়েছেন। আমরা মনে করি তারা সবসময়ই সম্মান পাওয়ার যোগ্য, স্মরণ করার যোগ্য। আমরা সেই কাজটিই করার চেষ্টা করি।’ বিভিন্ন সমর্থক দলের কার্যকরী কমিটি থাকে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৮০ সালে মহাপাগল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকরি কমিটি গঠন হয়নি। সবাই যেন এক কাতারে । কার্যকরি কমিটির বিশাল বহর না থাকলেও যে সুন্দরভাবে ব্যতিক্রমী আয়োজন করা যায় সে প্রমাণ দিয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দল মহাপাগল।
×