ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংগ্রাম ও সংস্কৃতির স্মারক হয়ে থাকা ফেব্রুয়ারি মাস বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। যে স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা’ হয়ে উঠেছিল; তার বীজ রোপিত হয়েছিল এই ফেব্রুয়ারিতে বুড়িগঙ্গা তীরে। আজ শুরু হচ্ছে সেই মাস। আজ থেকে মাসজুড়েই দেশের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হবে সেই অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...।’ মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলা মায়ের বীর সন্তানরা ১৯৫২ সালের এই মাসে গড়ে তুলেছিলেন এক অগ্নিঝরা আন্দোলন। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভাষার অধিকার। ফেব্রুয়ারির ফেরিতে চেপে বাংলা ভাষার উজানযাত্রা নিছক প্রতীকী অর্থে নয়, বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল এক নদী রক্তের বিনিময়ে। সেই বাংলা এখন বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকার বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ছড়িয়েছে নদীপথে। ক্রমে ক্রমে ছড়িয়েছে অসম, ত্রিপুরা ছাড়িয়ে আন্দামান-নিকোবর দীপপুঞ্জ, মেঘালয়, বিহার, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, দিল্লীসহ বিভিন্ন রাজ্যে। দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান ও নেপালেও রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাভাষী। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তানেও কর্মসংস্থান ও অভিবাসনসূত্রে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালীরা, তাদের সঙ্গে সঙ্গে ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার বিচরণভূমি হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের সীমানা ছাড়িয়ে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। দূরপ্রাচ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাঙালির ভাষাগত মর্যাদা ও মননের প্রধান প্রতীকে পরিণত হওয়া শহীদ মিনারও এখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বাইরেও। বিশেষত, গঙ্গাপারের পশ্চিমবঙ্গ, গোমতী-বিধৌত ত্রিপুরা, ব্রহ্মপুত্রের কন্যা অসম, সোমেশ্বরী বা সিমসাং ঘেরা মেঘালয়, সুবর্ণরেখা সজ্জিত ঝাড়খ-, গোদাবারি গর্বিত ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন জনপদে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পর সেই বিভক্তি ও বিভেদ কমতে থাকে। রাজনৈতিক সীমারেখার দু’পাশে থাকা একই ভাষার বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাড়তে থাকে। বাঙালীর প্রথম রাষ্ট্র বাংলাদেশের বাইরে থাকা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্যও গৌরবের বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গা পাড়ের ঢাকায় ও বরাক পাড়ের শিলচরে যে দামাল তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তারা হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় পরিচয়- নির্বিশেষে সকল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর নায়ক। শ্রদ্ধা, শোক ও পুষ্পে পুষ্পে তারা স্মরিত হতে থাকে বাংলাদেশের বাইরে ভারতের বাঙালী অধ্যুষিত জনপদগুলোতেও। নির্মিত হয় স্থায়ী শহীদ মিনারও। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে বাকি বিশ্বে সগৌরবে মাথা উঁচু করছে বাংলা ভাষার শহীদ মিনার। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের টেমস নদীর তীরের লন্ডন, ফ্রান্সের ক্রুজে নদী তীরবর্তী বারি, ইতালির টেভেরে নদী তীরবর্তী রোম, জাপানের সুমিদা তীরবর্তী টোকিও, কানাডার হাম্বার তীরবর্তী টরন্টো, অস্ট্রেলিয়ার পারামাটা তীরবর্তী সিডনিতে তৈরি হয়েছে স্থায়ী শহীদ মিনার। পটোম্যাক পাড়ের যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধশতাধিক শহরসহ পদ্মাপাড়ের বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন বাঙালী অধ্যুষিত জনপদে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার। ভাষার জন্য বুড়িগঙ্গাপাড়ের দামাল সন্তানদের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও আবেগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর। ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বাঙালীর একান্ত গর্ব ও শোকের ঘটনাটি কেবল বাংলা ভাষা নয়, আদায় করে বিশ্বের সব মাতৃভাষার জন্য স্বীকৃতি। যে দিবস বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীরাই পালন করত, এখন তা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে। স্মরিত হয় বাংলা ভাষার শহীদ ও সংগ্রামীরা। আমাদের শহীদ মিনার স্থান পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাসংক্রান্ত জাতিসংঘের অফিসিয়াল সাইটে। নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর পাশাপাশি বিশ্বের সব জাতি এখন মনে রাখে বাংলা ভাষাকেও। সেই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক মর্যাদা দেয়ার দাবি সামনে রেখে। এ দাবি আদায় সহজ নয়। কিন্তু যে ভাষার স্বভাব হচ্ছে উজানযাত্রা, তার সামনে কোন স্রোতই সাঁতারের অনুপযোগী হতে পারে না।
×