ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৬ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে আসা ৮০ ভাগ রোহিঙ্গা নারী সেদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশে আসা ৮০ ভাগ রোহিঙ্গা নারী সেদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মিয়ানমার সরকার থেকে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হলে রোহিঙ্গা সঙ্কট অনেকটাই সমাধান হবে। এছাড়া শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হয়নি। এর পেছনে আরও নানা কারণ রয়েছে। ঢাকায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশে সফররত কফি আনান কমিশনের সদস্যরা এসব কথা বলেছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে জানিয়েছেন কফি আনান কমিশনের সদস্যরা। মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) মিলনায়তনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন কফি আনান কমিশনের সদস্যরা। এরপর সাংবাদিকদের মুখোমুখি আনান কমিশনের সদস্য লেবানিজ নাগরিক ঘাসান সালামে বলেন, একমাত্র ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের ফলেই যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে এসেছেন তা নয়। এটার সঙ্গে অন্যান্য বিষয়গুলোও জড়িত। মানবাধিকার, জাতিগত, মুক্তভাবে চলাচল, নাগরিকত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোও জড়িত। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ঘাসান সালামে জানান, রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়ে আমরা প্রয়োজনে অন্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও আলোচনা করব। তিনি বলেন, এই কমিশন কয়েক মাস আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমরা কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা সাহায্য করেছে, এজন্য সন্তোষ প্রকাশ করছি। মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, কমিশনের সুপারিশ রাতারাতি বাস্তবায়িত হয় না। তবে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হলে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এত বছর পরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি কমিশন হয়েছে। আজ তাদের মধ্যে যা হয়েছে, মতবিনিময় হয়েছে। তারা কিভাবে চিন্তা করছে, আমরা কিভাবে চিন্তা করছি, সেটাই আলোচনা হয়েছে। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে কি থাকবে, সেটা আমরা জানি না। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। মতবিনিময় অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, কফি আনান কমিশনের সদস্যরা এসেছিলেন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমরাও আমাদের পর্যবেক্ষণ তাদের বলেছি। আমরা বলেছি, রোহিঙ্গারা শান্তি চায়। তারা ফিরে যেতে চায়। তবে তারা সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফিরে যেতে চায়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই কমিশনের প্রতিবেদন কবে জমা দেবে সেটা আমরা জানি না। তবে দুই দেশের সরকার একমত না হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও তিনি জানান। মতবিনিময় অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক আসিফ মুনীর বলেন, কমিশনের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। কেননা তারা মিয়ানমার সাইডে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পাননি। তবে তাদের কমিশন মিয়ানমার সরকারকে যে সুপারিশ দেবে, সেটা মানার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও কমিশনের কার্যকারিতা রয়েছে। সূত্র জানায়, মতবিনিময় বৈঠকে মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন, এখান থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশীরা রাখাইন প্রদেশে গিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ করেন। তাদের বলা হয়, এখান থেকে (বাংলাদেশ) রাখাইন প্রদেশে কোন বাংলাদেশী সেখানে অবস্থান করার লক্ষ্যে কখনই যাননি। আনান কমিশনের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন এবং লেবানিজ নাগরিক ঘাসান সালামে। মতবিনিময়ে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) অধ্যাপক সি আর আবরার ও অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুর্শিদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা, বিসের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুন্সী ফয়েজ আহমদ প্রমুখ। বিসে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতবিনিময়ের আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন কফি আনান কমিশন দলের প্রতিনিধিরা। আর বিসে মতবিনিময়ের পরে বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে গত ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন কফি আনান কমিশনের তিন সদস্য। এরপর গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি তারা কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। ওই সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও), জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচসিআর) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে জানিয়েছেন বাংলাদেশে সফররত কফি আনান কমিশনের সদস্যরা। মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ে নিজ কক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে কমিশন সদস্যরা এসব তথ্য জানান। সাক্ষাত শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কফি আনান কমিশনের সদস্যরা রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের অভিযোগের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তাদের কোন দ্বিমত নেই। কমিশন সদস্যরা অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন, কমিশন সদস্যরা আমাকে জানিয়েছেন মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ নারীই মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার। উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখ হতে পারে।
×