ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

এবার কেন মোক্ষম শীত পড়লো না, তা নিয়ে হাটেবাটেমাঠে আলোচনা সরগরম। বৃহস্পতিবার ভর সন্ধেবেলা উত্তরায় ফিরে ফোনের ওয়েদার অ্যাপসে চোখ রেখে দেখি আটাশ ডিগ্রি! রীতিমতো অসহ্য গরম। সেদিন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ঢাকায় ৩০ ও ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোনো কোনো বিকেলে মনে হচ্ছিলো আগাম ফাল্গুন বুঝি এসে গেল। রাজধানীর তাপমাত্রার এই স্বেচ্ছাচারী ওঠানামায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না পারলে নির্ঘাৎ অসুখবিসুখে ভুগতে হবে। তাই সাধু সাবধান! মহানগরে গ্রাম রচনা ঢাকাকে আমরা মহানগরী বলি বটে, যদিও এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মফস্বল-ভাব রয়ে গেছে। আরবান হয়েও কোন কোন জায়গায় ঢাকা গ্রামীণ। নগরীর বিশাল সব অট্টালিকার ছায়ায় গৃহহীন নর-নারীর কথা ভূপেন হাজারিকা তার একটি গানে বলে গেছেন। নিউ ইস্কাটনের মাঝবরাবর উঠে গেছে নতুন ফ্লাইওভার। ফলে এলাকার দৃশ্যপটে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বটে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে এখানে। নানা চিকিৎসার জন্য মোটর গাড়ির হরদম ভিড় লেগে আছে কাছেই। সব মিলিয়ে এলাকাটি এখন অনেকটা আরবান, বা নাগরিক। এখানে একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় রয়েছে মার্কেট, দোতলায় একটি ব্যাংকের কার্যালয়। ওপরে বাদবাকি সব ফ্ল্যাটবাড়ি। এই ভবনের নিচে এক কোণে দস্তুরমতো একখানা ‘গ্রাম’, বলতে পারি গ্রামের বাজার যে বিরাজ করছে সেটি আগে লক্ষ্যই করিনি। ওই যে কবি বলে গেছেন, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঘের রোদ্দুরে সয়লাব এখানে রীতিমতো প্রাণের পসরা বসে যায়। বলতে পারি, জীবনের যে জঙ্গমতা রয়েছে এখানে, তা চোখে পড়ার মতো চোখ নেই সাহেবসুবোদের। একটা মুভি ক্যামেরা চালু করে শুধু ডানে-বাঁয়ে ঘোরাতে থাকলে যেসব দৃশ্য ও কথামালা রেকর্ড হবে শুধু সেটুকুতেই ‘জীবননাটক’ উপস্থাপন করা সম্ভব। একটি বয়সী বৃক্ষ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রান্সটিারের দুই বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথী হয়ে, যার উজাড় হয়ে আসা পাতাগুলোর অর্ধেক সবুজ, বাকি সব পাকা পেয়ারার মতো রক্তিম। মার্কেটের ডান দিকের কোনায় পানির পাম্পের জন্য যে ঘেরাটোপ রয়েছে তার অস্থায়ী দেয়াল ঘেঁষে বসেছে জুতো পালিশওয়ালা। তার পাশেই পরিত্যক্ত সোপান। সেখানে রোদ ঝলমল করে। তরুণ-যুবারা এখানে বসে দুদ- জিরোবার সুযোগ পায়। খোশগল্পে মাতে। একা কোন তরুণ পালিশের জন্য জুতো খুলে দিয়ে এখানে বসে স্মার্ট ফোনে চ্যাটিং করে। উল্টো দিকে রকমারি তারের সুরক্ষার প্রয়োজনে দুটো দ-ায়মান কাঠামো রয়েছে। অনেকটা দেয়ালের কাজই করেছে মাথা সমান উঁচু তারের দুটি বাক্স। তার আড়ালেই চা-খানা; টুল-বেঞ্চি সবই রয়েছে। বিপরীত দিকে পান-সিগারেটওয়ালার ভ্রাম্যমাণ পসরা। মোটরসাইকেল রাখার বিশেষ সুবিধা পাওয়ায় সেটি রেখে দুয়েকজন চা-নাস্তার অর্ডার দিচ্ছে। প্রাণবন্ত এক ছবি। রিক্সাওয়ালার পাশেই বসে পড়েছে মোটরসাইকেল আরোহী। কে আশপাশের দোকানি, কে মুটেমজুর। কে অফিসের কেরানি, কে ছাত্রÑ তার কোন বাছবিচার নেই। জুতো পালিশের অবকাশে এক সাহেব আড়চোখে চেখে নিচ্ছে ওই ঝলমলে জনসমাবেশকে। বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় রাজনীতি এখানেও অনিবার্যভাবে আলাপচারিতার প্রসঙ্গ। বাঙালীর প্রিয় অভ্যাস রাজাউজির মারা, সেটিও এখানে দিব্যি ক্রিয়াশীল। সিগারেটের ধোঁয়া, চায়ের কাপের টুংটাং, নিচু গলা আর গলা চড়ানোর কসরতের ভেতর বারো গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলো নিষ্ঠুর নগরীর বুকে নিজেদের অজান্তেই একখানা ‘গ্রাম’ রচনা করে চলেছে। শুধু ছুটির দিনে... কয়েক সপ্তাহ আগে এই কলামে ‘কর্মদিবসে নয় কর্মসূচী’ শিরোনামের লেখায় আমরা কিছু কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমরা আশা করতেই পারি একদিন পরিস্থিতি বদলাবে। কর্মদিবসে কর্মসূচী দেবেন না কোন সংগঠন। ঢাকাবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। ঢাকার কোন একটি প্রধান ট্রাফিক পয়েন্টে মাত্র ১৫ মিনিট স্থবির রাখা হলে তার ধকল কমপক্ষে দু’ঘণ্টার হবে গোটা ঢাকা শহরেÑ এটা বাস্তবতা। তাই আর নয় দিবালোকে মহোৎসব। জনসংখ্যার চাপে নাকাল ঢাকাবাসীর জন্য ইতিবাচক খবর হলো সম্প্রতি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ঘোষণা দিয়েছে শুক্র ও শনিবার ছাড়া তারা কোন শোভাযাত্রা বের করবে না। রাজপথে অনেক জনভোগান্তির পর এমন ঘোষণা অভিনন্দনযোগ্য। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য দল ও সংগঠনও যদি অভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, তাহলে রাজধানীবাসীর বিশেষ উপকার হবে। দেশে বিরোধী দলের রাজপথকেন্দ্রিক কর্মসূচী প্রায় নেই বললেই চলে। কার্যত রাজধানীতে যা দেখা যায় তা হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও শরিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচী। কিছুদিন আগেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীর মিছিলের জন্য ঢাকায় দুঃসহ যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। কোন সড়কে মিছিল নামা মানে সেই সড়কটি বন্ধ হয়ে থাকা। পেশাজীবী, শিশু-বৃদ্ধ-নারী, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সংকটাপন্ন রোগীদের এ্যাম্বুলেন্স- সব বন্ধ করে মিছিল করার কোন মাহাত্ম্য থাকতে পারে কি? যা হোক, জনমানুষকে কষ্ট না দেয়া রাজনীতিতে প্রথা হয়ে দাঁড়াক। সুরের দুই উৎসব জ্যাজ-ব্লুজ ও বাংলা খেয়াল গত শীতে জ্যাজ-ব্লুজ উৎসবের স্মৃতি অনেকের জন্যই সুখপ্রদ। ছিল ভুবনজয়ী গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিনের গিটারের সুর, চায়না মোজেজের মনমাতানো গান। রবিবার থেকে ফের শুরু হয়েছে তিন দিনের জ্যাজ এ্যান্ড ব্লুুজ ফ্যাস্টিভ্যাল ঢাকা-২০১৭। এ বছর আসরটি বসেছে সুউচ্চ হোটেলের ছাদে। হোটেল লা মেরিডিয়ানের ছাদে বিশ্বের বেশ ক’জন খ্যাতিমান শিল্পীর কাছাকাছি বসে শোনা যাচ্ছে গান। উৎসবে এবারে গাইছেন শিকাগোর লরি বেল, ডেনমার্কের জ্যাকব ডিনিসেন, ভারতের রণজিৎ বারোত, যুক্তরাজ্যের গ্যারি পিটার হাজব্যান্ড, ভারতের সোলমেট, ঢাকার আরমীন মুসা এবং বেশ কয়েকটি ব্যান্ড। অনলাইনে ঢুঁ মেরে দেখলাম, এক সন্ধ্যার টিকেটের দাম দু’হাজার টাকা। তিন দিনের টিকেটের দাম পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা। বিশিষ্ট সুরস্রষ্টা আজাদ রহমান ফোন করে বললেন, মনে আছে তো মঙ্গলবার বাংলা খেয়াল উৎসবের কথা? কিছুকাল আগে বিটিভি স্টুডিওতে দেখা হলে উৎসবরে প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। জনকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখতেন বাংলা খেয়াল নিয়ে। বললাম, জ্বি মনে আছে। খুশি হলেন তিনি। বললেন, ইউনেস্কোর সহযোগিতায় আমার ‘প্রথম বাংলা খেয়াল’ এলপি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। আমি বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছিÑ কেননা আমার সর্বসত্তা সবকিছুর সঙ্গে বাংলা খেয়াল ও বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মিশে আছে। দেশে-বিদেশে আমি বাংলা খেয়ালের অনেক অনুষ্ঠান করেছি। জার্মানী, আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারতে শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত একাডেমিতেও বাংলা খেয়াল ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কর্মশালা ও অনুষ্ঠান হয়েছে। এন এইচ কে-তে বাংলা খেয়াল গেয়েছি। ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচভ্যালি, বিবিসিতে বাংলা খেয়াল নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়েছে। লন্ডনে স্প্রেকট্রার্ম রেডিওতে অনুষ্ঠান হয়েছে। দেশ-বিদেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ আমার রচিত বাংলা খেয়াল তথা বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। এই অনুপ্রেরণাতেই আমি বাংলা খেয়াল ও বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ধরে আছি। বলা দরকার আজ মঙ্গলবার তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘বাংলা খেয়াল উৎসব-২০১৭’। সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে কাল ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা পর্যন্ত চ্যানেল আই স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হবে এ উৎসব। উৎসবে অংশ নেবে ঢাবির সঙ্গীত বিভাগসহ ৩৪টি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিল্পী। এবারের উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ নবীন শিল্পীদের অংশগ্রহণ। শুরু হচ্ছে ভাষার মাস বেরুলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সংকলন কাল থেকে শুরু হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষার মাস শুধু ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাসই নয়, মাসটি মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসে। বাঙালীর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেজন্য বিশেষ গৌরব করার কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নোতে মাতৃভূমির অকুতোভয় সন্তানরা আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন, সে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় ব্যর্থ হলে পরম গৌরবময় সেই আত্মদান বৃথা যাবে। তাই ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য, মান এবং সৌন্দর্য যাতে অক্ষুণœ থাকে সে লক্ষ্যে সক্রিয় থাকা। মাতৃভাষা সহজাতভাবেই মানুষ আয়ত্ত করে থাকে বটে, যদিও তার চর্চা বা প্রয়োগে সচেতন না হলে সে ভাষার সুস্থতা ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। ভাষা ব্যবহারে হেলাফেলা ও অসতর্কতার কারণে রুদ্ধ ও দূষিত হয়ে উঠতে পারে প্রাণের ভাষাÑ এটা মনে রাখা কর্তব্য। ভাষার মাস তাই ভাষার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতার মাসও। ভাষার মাসে বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা জাগিয়ে তোলা এবং ভাষা-সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে শুরু করা এবং বছরভর তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নবীন-তরুণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, আকাক্সক্ষা আর স্বপ্নের আদানপ্রদান মাতৃভাষার মাধ্যমেই সবচেয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারে। ভাষার মাস মানেই ঢাকায় মাসব্যাপী মহান একুশে গ্রন্থমেলা। এই বইমেলায় হাজার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হবে। এই লেখা যারা পড়ছেন, সেসব পাঠকের কাছে অনুরোধ অন্তত একটি বারের জন্য বইমেলায় যান। অন্তত দুটি বই কিনুন, তার একটি উপহার দিন প্রিয় বন্ধুকে। এভাবেই ভাষার মাসটিকে অর্থবহ করে তোলায় ভূমিকা রাখুন। এ লেখা প্রেসে যাওয়ার সময় জানতে পারলাম আজই বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের সংকলন-‘ওঙ্কারসমগ্র’। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস, সাত মার্চসহ নানা উপলক্ষে তাঁর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুনে শুনেই তাঁকে চিনেছে নতুন প্রজন্ম। প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য বঙ্গবন্ধুর শতাধিক ভাষণ থেকে বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ ৬৭টি ভাষণ শ্রুতিলিপিরূপে প্রকাশ করেছে। বইটি শ্রুতিলিখন ও সম্পাদনা করেছেন তরুণ লেখক নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। এসব শ্রুতিলিপির বানান বঙ্গবন্ধুর মুখের উচ্চারণ অনুযায়ী রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ থেকে ৮ মার্চ ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো স্থান পেয়েছে এই বইতে। ৩৫০ পৃষ্ঠার রয়েল সাইজ এই বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে ৭৫০ টাকা। ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×