ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হবে?

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হবে?

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় খাতে একক বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শীঘ্রই এ অভিযান শুরু করা হবে। তবে তার আগে এ হাউসের কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িতদের সব ধরনের অপকর্ম থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলতে মেসেজ দেয়া হয়েছে। সোমবার দুদকের উচ্চপর্যায়ের তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। প্রতিনিধি দল কাস্টমসের প্রতিটি বিভাগ ঘুরে দেখেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিদর্শন ও বৈঠক চলে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দুদকের কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম, মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী এবং মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ) আতিকুর রহমান। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে জাতীয় কোষাগারে বছরে গড়ে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যোগান দেয়া হয়ে থাকে। এ রাজস্ব আদায় হয় চট্টগ্রাম বন্দর, বিমান বন্দর বিভিন্ন আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো) থেকে। দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের প্রায় ৯০ ভাগ আমদানি ও রফতানি পণ্য পরিবাহিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস একক বৃহত্তম। এ কাস্টম হাউসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন খাতে বহুমুখী দুর্নীতির ঘটনা রয়েছে। বিশেষ করে আমদানি পণ্যের শুল্ক আদায়ে আমদানিকারক ও কতিপয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের পরস্পর যোগসাজশে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, মিথ্যা ঘোষণা, পণ্যের গুণগত মানে ভেজাল, পরিমাণ, এইচএস কোড জালিয়াতিসহ হাজারও অনিয়ম বিদ্যমান। কাস্টমস কার্যক্রম এখনও পরিপূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড না হওয়ার প্রেক্ষাপটে জালিয়াত চক্র এ সুযোগ গ্রহণ করছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। সোমবার দুদকের তদন্ত টিম চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম থেকে এখনও চলমান ম্যানুয়েল পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিজিটালাইজড করার পরামর্শ দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট কোন সময় না দিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অবিলম্বে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে তাদের পক্ষ থেকে এরপর আর কোন সময় দেয়া হবে না এবং কোন অজুহাত আমলে আনা হবে না। দুদক কমিশনার আমিনুল ইসলাম কাস্টম হাউসে ব্রিফিংয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতর্কতা উচ্চারণ করেন। কাস্টমস কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে অবিলম্বে সাসপেন্ড করুন। বিভাগীয় ব্যবস্থা নিন। দুদক দেখতে চায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বা হয়েছে। যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে দুদকের পক্ষ থেকে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যার পরিণাম হবে দৃশ্যমান এবং দুর্নীতিবাজদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী কাস্টমস হাউস পরিদর্শন ও বৈঠক শেষে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, দুদকের পক্ষ থেকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক পর্যায়ে এটা একটি কড়া। কাস্টমসের প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি বিরাজমান এমন অভিযোগ অহরহ। ফলে সরকার প্রতিবছর মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি এইচএস কোড জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্যের ভোক্তারা নিম্নমানের আমদানি পণ্য ক্রয় করছে। আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসার পর থেকে কাস্টমস কার্যক্রম যখন শুরু হয় এবং তা খালাস প্রক্রিয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে অবৈধভাবে অর্থ লোপাটের ঘটনা রয়েছে। যা কাস্টমসের সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, বার্থ অপারেটর এবং বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে স্পিড মানি হিসেবে অবহিত করা হয়ে থাকে। মূলত এর নাম ‘ঘুষ’। এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে জড়িতদের পক্ষ থেকে দুদকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। পণ্য আমদানিও রফতানি কর্মকা-ে কাস্টমস কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসহযোগিতা, মোটা অঙ্কের অবৈধ অর্থের দাবি নিয়ে তারা অতিষ্ঠ। এসব ঘটনা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত খুবই কম। এর পাশাপাশি এ কাস্টমস হাউসকে ব্যবহার করে দেশের অঢেল বিত্তের মালিক বনে যাওয়াদের সংখ্যাও কম নয়। চোরাচালানি পণ্য থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্য এবং আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ও মিথ্যা ঘোষণার পণ্যের চালান হরহামেশা আসছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই চলে যত অপকর্ম। ফলে সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে দুর্নীতিবাজরা স্পিড মানির নামে ঘুষ দিয়ে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। পাশাপাশি ঘুষ রেওয়াজে পরিণত হয়ে যাওয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাচ্ছে দুদক। উল্লেখ্য, দুদকের বর্তমান মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে শত শত কোটি টাকার ব্যাহত হওয়া জমি উদ্ধার করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এরপর আরও কয়েকটি সংস্থায় কাজ করে বর্তমানে দুদকের মহাপরিচালক হয়েছেন। তার বন্দরে কাজ করাকালীন তিনি দেখেছেন কাস্টমসের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। শুনেছেন ঘুষ গ্রহণের সাতকাহন। দুদক সদর দফতরে কাস্টমসের দুর্নীতি নিয়ে এন্তার অভিযোগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যকর তদন্ত চালানো গেলে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের স্বরূপ উদঘাটিত হবে। এ ধারণা থেকেই সোমবার দুদকের উচ্চ পর্যায়ের এ প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস পরিদর্শন করে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে তাদের ম্যাসেজ পৌঁছে দিয়েছেন। এদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, তারাও বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কাস্টমসের সকল কর্মকা-ে সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা নয় উল্লেখ করে জানানো হয়, প্রকৃত অর্থে যারা দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এছাড়া বহু আমদানিকারক বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির বিষয়টিও মিথ্যা নয়। কিন্তু এ জাতীয় অনিয়ম জালিয়াতি রোধে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের বিদ্যমান জনবল ও টেকনিক্যাল যে সাপোর্ট রয়েছে তা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু পুরো রাজস্ব বোর্ড এবং এর অধীন সংস্থাগুলো এখনও পরিপূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড হয়নি সেক্ষেত্রে যা বিদ্যমান তা দিয়ে তাদের কর্মকা- সম্পন্ন করতে হচ্ছে। ফলে ফাঁকফোকরে অনেক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। বন্দর সূত্র মতে, এ বন্দরে বর্তমানে বছরে ২০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার বোঝাই পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এসব পণ্যের খালাস কার্যক্রমে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আহরিত হয়, যা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষীয় বক্তব্য হচ্ছে, এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে তাদের প্রয়োজনীয় জনবল রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া এখনও বেশ কিছু কার্যক্রম চলছে ম্যানুয়েলি। এ ফাঁকফোকরে এবং জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের কমতির সুযোগে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। সরকার পক্ষে রাজস্ব আহরণের প্রতিটি খাতকে ডিজিটালাইজড করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা সম্পন্ন হলে তারাও সকল ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাবেন। উল্লেখ্য, সম্প্রতি পালিত আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র কাস্টমস রাজস্ব আহরণে তারা বিশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা হিমশিম খাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষও এর বাইরে নয়। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগে গেল সপ্তাহে দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এককভাবে অনিয়ম দুর্নীতি ও জালিয়াতি, মিথ্যা ঘোষণা, এইচএস কোড জালিয়াতিসহ যত ধরনের অনৈতিক কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে তৎজন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এককভাবে দায়ী নয় বলেও তাদের বক্তব্য রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযাগ পাওয়া যাবে এবং তা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কারও কোন আপত্তি নেই। কাস্টম হাউস পরিদর্শন শেষে দুদক প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দর ভবনও পরিদর্শন করেন। বৈঠক করেন বন্দর কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল এবং বন্দর বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে।
×