ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুরুর আগেই উৎসবের আমেজ, সাংস্কৃতিক জাগরণের অপেক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

শুরুর আগেই উৎসবের আমেজ, সাংস্কৃতিক জাগরণের অপেক্ষা

মোরসালিন মিজান ॥ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আগামীকাল বুধবার বাঙালীর প্রাণের মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। বই ঘিরে এমন উৎসব সারা পৃথিবীতেই বিরল। শুধু উৎসব নয়। বই কেনাবেচা নয় শুধু। লেখক পাঠক প্রকাশকের এটি মিলনমেলা। মাসব্যাপী আয়োজন অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণের সৃষ্টি করে। সেই সময়টা সামনে রেখে সোমবার নিজেদের প্রস্তুতির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। প্রকাশকরাও যারপরনাই ব্যস্ত। স্টল সাজানোর কাজ করছেন তারা। সব মিলিয়ে মেলার আগেই মেলার আমেজ। বাংলা একাডেমির সংবাদ সম্মেলনের কথাই আগে বলতে হয়। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক জাগৃতি ঘটে। এবার এটি আরও সুগঠিত হবে। মানবিক হবে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বিগত দিনের আয়োজন অত্যন্ত সফল হয়েছে দাবি করে তিনি এবার আরও গোছালো মেলার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর তিনি চলে যান আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন প্রসঙ্গে। মেলার পাশাপাশি এই সম্মেলনের আয়োজন করছে বাংলা একাডেমি। এবারের আয়োজনে কী চমক থাকছে, তা আগ্রহ নিয়ে বলেন মহাপরিচালক। এর পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। আর তখনই মুখ্য হয়ে ওঠে একুশের চেতনা। একুশ মানে মাথা নত না করা। কিন্তু গত কয়েকটি মেলার আয়োজন দেখে মনে হয়েছে নতজানু নীতি গ্রহণ করছে একাডেমি। লেখক প্রকাশক খুন হচ্ছিল যখন, টুঁ শব্দটি করেনি। উল্টো মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অনুৎসাহিত করেছে। এ অবস্থায় ঘুরে ফিরে আসে একুশের চেতনা প্রসঙ্গ। এক প্রশ্নে জবাবে শামসুজ্জামান খান বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন কোন বই মেলায় আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার কাজ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বই নিষিদ্ধ ও স্টল বন্ধের কাজ নিজের মতো করে ওই মন্ত্রণালয় করবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। কিছুদিন আগেও একটি প্রগতিশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মেলার বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়। প্রবল প্রতিবাদের মুখে সিদ্ধান্ত থেকে একাডেমি সরে আসে। কিন্তু ততক্ষণে একাডেমির নতজানু নীতির কথা ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। বিষয়টির উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়, মৌলবাদীদের আস্ফালনে ভীত কিনা একাডেমি? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন শামসুজ্জামান খান। সাংবাদিকদের তার কক্ষে গিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। এর পরও আসতে থাকে প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন একাডেমির মহাপরিচালক। এভাবে মেলার আগেই এক ধরনের উত্তাপ টের পাওয়া যায়। এর আগে মেলার সর্বশেষ তথ্য জানান মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে তিনি বলেন, এবারও দুটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে মেলা। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে মূল আয়োজন। এখানে প্রায় ৪ লাখ বর্গফুট জায়গা। ১২টি চত্বরে সজ্জিত করা হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৯টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ১১৪টি ইউনিট। মোট ৪০৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবং বাংলা একাডেমিসহ ১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। লিটলম্যাগ কর্নারও প্রস্তুত প্রায়। ১০০টি লিটল ম্যাগাজিনকে এবার স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যাঁরা বই প্রকাশ করেছেন তাঁদের বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলা একাডেমির ২টি প্যাভিলিয়ন, একাডেমির শিশুকিশোর প্রকাশনাভিত্তিক বিক্রয়কেন্দ্র এবং একাডেমির সাহিত্য মাসিক উত্তরাধিকার-এর বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকবে শিশুকর্নার। এই কর্নারকে শিশুকিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারও ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হবে। তিনি জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-এর প্রচার কার্যক্রমের জন্য তথ্যকেন্দ্র থাকবে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রন্থমেলার প্রবেশ ও বহির্গমন পথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের নিরাপত্তাকর্মীরা। নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলায় আড়াইশত ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট বাঙালী মনীষার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা এবং সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। জালাল আহমেদ জানান, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের নতুন বিন্যাসে এবারের অধিকাংশ স্টল পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আনা হয়েছে। টিএসসি ও দোয়েল চত্বরের মূল প্রবেশ পথে এলইডি মনিটর স্থাপন করা হবে। এখান থেকে মেলা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও নির্দেশনা পাওয়া যাবে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘নতুন বইয়ের প্রদর্শনশালা’ করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন প্রকাশিত নতুন বই দিনভিত্তিক সাজানো থাকবে। সংবাদ সম্মেলন শেষে মেলার দুই ভেন্যু ঘুরে দেখা যায়, স্টল সাজানোর কাজে ব্যস্ত প্রকাশকরা। অধিকাংশ স্টল ও প্যাভিলিয়নের চেহারা অনুমান করা যাচ্ছে এখনই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা হয় তাম্রলিপি প্রকাশনীর কর্ণধার তরিকুল ইসলাম রনির সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের মূল কাজ শেষ। বাকি কাজ দু একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
×