ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাত জঙ্গী গোষ্ঠীর তিন শতাধিক দণ্ডিত আসামি পলাতক

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

সাত জঙ্গী গোষ্ঠীর তিন শতাধিক দণ্ডিত আসামি পলাতক

শংকর কুমার দে ॥ দেশের অন্তত সাতটি জঙ্গী গোষ্ঠীর ৩ শতাধিক জঙ্গী ফাঁসির দ-াদেশ, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা মাথায় নিয়ে পলাতক। বিগত ১৬ বছরে সারাদেশের বিভিন্ন থানাতে এই জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সহস্রাধিক। আলোচ্য সময়ে সহস্রাধিক মামলার আসামি জঙ্গীদের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছে ৫৬ জঙ্গীর। এর মধ্যে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে মাত্র সাত জনের। যেই ৭ জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদের বিরুদ্ধে মামলা, সাজা, পলাতক থাকার অভিযোগ রয়েছে তা হচ্ছে- হিযবুত তাহরীর, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), বাংলাদেশের জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমজেবি), শাহাদাত আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নব্য জেএমবি। এর মধ্যে কেবলমাত্র নব্য জেএমবি ছাড়া বাদ বাকি ছয় জঙ্গী সংগঠনই নিষিদ্ধ। এসব জঙ্গী সংগঠনের মামলার এজাহারভুক্ত জঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই জামিনে মুক্ত পর আর হদিস নেই। আবার অনেকেই গ্রেফতার এড়িয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এমন সংখ্যা চার শতাধিক জঙ্গী। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, নিষিদ্ধ করার পরও জঙ্গীরা এক জঙ্গী সংগঠন ছেড়ে অন্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে মিশে গিয়ে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে, জঙ্গী সংগঠন জেএমবি নিষিদ্ধ করার পর নব্য জেএমবির ব্যানারে এসে জঙ্গী তৎপরতা চালায় জঙ্গীরা। এর মধ্যে জঙ্গী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হলে জঙ্গীবিরোধী অভিযান ব্যাপক, বিস্তৃত ও কঠোর করায় জঙ্গী নির্মূল অভিযানে সফলতা আসে। তবে পলাতক জঙ্গীদের গ্রেফতারের বিষয়টি জোরদার না হওয়ায় গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে সক্ষম হচ্ছে জঙ্গীরা। পলাতক এসব জঙ্গীরা এখনও আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়, যদিও জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে প্রথম জোরালোভাবে ২০০০ সাল থেকেই মূলত জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি প্রকাশ পায়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে বোমা হামলা চালানোর হতাহতের ঘটনার ৮ বছর পর ২০০৯ সালে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নান, আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও মাওলানা শফিকুর রহমানসহ আটজনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। এ ছাড়াও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। কিন্তু সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আবু বকর, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান, আবদুল হাই জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির ক্ষমতার সময়ের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন বিদেশে থেকে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা করে জঙ্গীরা তাদের শক্তির জানান দেয় জঙ্গীগোষ্ঠী। এ ঘটনায় পাঁচ শতাধিক জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছিল। এ ঘটনায় নিম্ন আদালতে দ-প্রাপ্ত সাত জঙ্গীকে খালাস দেন উচ্চ আদালত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করলেও রবজেল হোসেন, আজিজুর রহমান, ইউনুস আলী, আজিম উদ্দিন, আবু তালেব আনসারী, তরিকুল ইসলাম ও মতিন মেহেদীসহ সাত জঙ্গীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। খালাস পাওয়ার পরই তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। কেবলমাত্র এই ঘটনার মামলাই তিন শতাধিক জঙ্গী পলাতক রয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, পলাতক জঙ্গীদের মধ্যে অন্তত জেএমবির ৬৭, হিজবুত তাহরীরের ৫২, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৩৮, জেএমজেবির ১৮, হরকাতুল জিহাদের ৩২, লস্কর-ই- তৈয়বার ৩২, আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের ২৫, হিজবুত তাওহীদের ১৫, জয়স-ই-মোহাম্মদের ২২, শাহাদত-ই-আল হিকমার ১২, আল হিকমার ১২ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩১৮ জঙ্গী মামলা। এ পর্যন্ত বভিন্ন মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়েছে ৫৬ জনের। তার মধ্যে জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ সাত জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেএমবির জঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকরের পর বেশ কিছুদিন জঙ্গী তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা করার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। আলোচনায় আসে জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টিও। এ ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের গ্রেফতার হয় সাত সদস্য। এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা। তার ছবি গণম্যাধ্যমে প্রকাশ করে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিগত তিন বছরেও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ফেনীর দাগনভূঞার উত্তর জয়লস্করপুরে আবুল কালাম আজাদের পুত্র রানা। লেখাপড়া করেছে আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, নটর ডেম কলেজ ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। রাজীব হায়দার হত্যাকা- থেকে শুরু করে ব্লগার হত্যাকা-ে বার বার আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম রাজধানীসহ দেশের শিক্ষিত ছেলেদের টার্গেট করে এই নিষিদ্ধ সংগঠনে নিয়ে জঙ্গী বানানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সংগঠনের কয়েকটি উইং আছে। রিক্রুটিং ও মিডিয়া উইংয়ে অনেক সদস্য রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রাহমানিসহ অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। তবে এই সংগঠনটির প্রধান সামরিক কমান্ডার সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া এখনও গ্রেফতার হননি। এ কারণে জঙ্গী তৎপরতা শেষ হয়ে গেছে জোর গলায় বলতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে মূলত ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগে সহস্রাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। অনেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন। তদন্তে কারও কারও সম্পৃক্ততা না পেয়ে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তাই দেশে কতজন জঙ্গী আছে তা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। তবে পলাতক জঙ্গীরা দেশের বাইরে থেকেও নেতৃত্বে দিতে পারে বলে জানান তিনি। উদাহরণ হিসেবে জানান, বাইরের একটি দেশে হিযবুত তাহরীর প্রকাশ্যে সভা-সেমিনার করছে। আমাদের দেশে সংগঠনটি নিষিদ্ধ হলেও সেখানে তা নিষিদ্ধ না। আবার নব্য জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনে যোগ দিতে বিদেশে গেছেন বা নিখোঁজ রয়েছেন এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, নব্য জেএমবির নামে গত ২০১৬ সালে গুলশানে ইতালিয় নাগরিক হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে জাপানী নাগরিক হত্যাকা-, ধর্মযাজক, পুরোহিত, পুলিশ, ভিন্নমতাবলম্বী, ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক ও মুক্তমনাদের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে জঙ্গী তৎপরতা জোরদার করে জঙ্গীগোষ্ঠী। এরপর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোতে বিত্তবান ঘরের উচ্চশিক্ষিত ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, পেশাজীবীদের সমন্বয় ঘটানোর খবর জঙ্গী তৎপরতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যুক্ত হয়ে অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র, সুইসাইড ভেস্ট, বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার ও মজুদ ভা-ার। জঙ্গীগোষ্ঠীর মোকাবেলা ও দমনে পুলিশ প্রশাসনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠনসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। জঙ্গী দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে গত ১ জুলাইতে জঙ্গী হামলার ঘটনার পর মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজধানীসহ দেশব্যাপী জঙ্গী বিরোধী অভিযান জোরদার করায় অনেক জঙ্গী নিহত, গ্রেফতার, আত্মগোপনে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে জঙ্গী তৎপরতা নির্মূল করা না গেলেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে।
×