ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ মানববন্ধন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

মিয়ানমারে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ মানববন্ধন

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজারে দুই দিনের সফরে রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শ কমিশনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল দ্বিতীয় দিনের মতো রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও বস্তি পরিদর্শন এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমার সরকার গঠিত কফি আনান কমিশনের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনেছেন মনযোগসহকারে। ওই সময় রোহিঙ্গারা স্বদেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি বলে প্রতিনিধি দলকে জানায়। দ্বিতীয় দিনের মতো রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে আনান কমিশনের তিন সদস্য মিয়ানমার নাগরিক উইন ম্রা, ওআই লিয়ন ও লেবাননের নাগরিক ঘাসান সালামে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় উখিয়ার কুতুপালং রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। ওই সময় রোহিঙ্গারা প্রতিনিধি দলের সামনে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মানববন্ধন করে। রোহিঙ্গারা আনান কমিশনের প্রতিনিধি দলের কাছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গাদের এসব দাবি আগ্রহসহকারে শুনলেও কোন মন্তব্য করেনি। তবে তাদের ওপর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী শুনে আশ্চর্য হয় প্রতিনিধি দল। সোমবার দুপুর দুটোর দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। ওই সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, তাদের অবস্থানসহ বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করা হয়। বৈঠক ও আলোচনা শেষে প্রতিনিধি দলটি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা ও পরিস্থিতি জানতে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ও বস্তিগুলো পরিদর্শন করে রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শ কমিশনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। তারা উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা শরণার্থী বস্তিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। পরিদর্শনকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বাকী বিল্লাহ, জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি, ইউএনএইচসিআর ও আইওএমের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। তিন সদেস্যের প্রতিনিধি দলটি রবিবার প্রথমে উখিয়ার বালুখালী গহীন পাহাড়ী এলাকায় নতুন করে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শরণার্থী বস্তি এবং পরে টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়ার রোহিঙ্গা বস্তিগুলো পরিদর্শন করে। ওই সময় দলটির সদস্যরা গত বছরের অক্টোবর মাসে রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর নেন এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গারাও তাদের ওপর সেনাবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরে। রোহিঙ্গারা প্রতিনিধি দলের সম্মুখে দাবি জানায়, তাদের নাভিছেঁড়া দেশ মিয়ানমার থেকে তারা ইচ্ছা করে পালিয়ে আসেনি বাংলাদেশে। দেশটির সেনা সদস্যরা জোরপূর্বক কেড়ে নিয়েছে তাদের জমিজমা। জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরবাড়ি। হত্যা করেছে পুরুষদের। ধর্ষণ করেছে যুবতী ও কিশোরীদের। সন্ত্রাসীরা বিজিপি ক্যাম্পে হামলে পড়লে এ দায় নিরীহ রোহিঙ্গারা নেবে না। তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে তারা কমিশনের প্রতিনিধি দলের সম্মুখে বিক্ষোভ করে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জনগণের কল্যাণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউং সান সুচি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেন। কফি আনান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় মিয়ানমারের ছয় নাগরিক ও তিন বিদেশী বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত কমিশন এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সুপারিশ জমা দেবে। রাখাইন রাজ্যের সব নাগরিকের মানবিক ও উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপাদানগুলোকে নিয়ে কমিশন সুপারিশ তৈরি ইত্যাদি নিয়ে কমিশন কাজ করছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারে রাখাইনের মংডুর কাউয়ারবিলে সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় ৯ বিজিপি সদস্য নিহত ও তাদের বন্দুক ও গোলাবারুদ লুটে নেয় সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত দাবি করে দেশটির সেনা সদস্যরা গণহত্যা, গণধর্ষণ, গুম, নির্যাতন, বাড়িঘরে আগুন ও ভিটেমাটি ছাড়া করে রোহিঙ্গাদের। ১২ নবেম্বর থেকে ওই রোহিঙ্গারা দলে দলে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। বিজিবির নজরে পড়লে ওসব রোহিঙ্গাকে স্বদেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। তারপরও কৌশলে এ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্য থেকে অন্তত ৬৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে এ দেশে রয়ে গেছে অন্তত পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এরা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে বসতগৃহ তৈরি করে ও ভাড়া বাসায় বসবাস করছে অবৈধভাবে। এদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাসী বিদ্রোহী গ্রুপে। মার্কিন দূতাবাসের ৯ সদস্য কক্সবাজারে ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি জানতে এবং শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করতে কক্সবাজার এসেছেন মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মার্সা বার্নিকাটসহ নয় সদস্যের প্রতিনিধি দল। সোমবার বিকেলে বিশেষ বিমানযোগে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার পৌঁছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন। এরপর বিকেল ৫টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি দলটি। বৈঠক শেষে প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ে যান। সেখানে আরআরআরসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি এবং সমস্যা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০ টায় মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি দল টেকনাফের নয়াপাড়ার নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। এরপর দলটি লেদার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শনের কথা রয়েছে। সেখান থেকে ফিরে মঙ্গলবার বিকেলে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি দলটি বিমানযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন বলে জানা গেছে।
×