ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণ ॥ অনুজ আরেফিন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

স্মরণ ॥ অনুজ আরেফিন

ড. হেলাল উদ্দীন খান শামসুল আরেফিন আমার ছোট ভাই, আমাদের পরিবারের আট ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। গত ২৪ ডিসেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার স্ত্রী সুরাইয়া ১৯৯৬ সালে এমনিভাবে তাকে ও তার এক ছেলে এক মেয়ে রেখে চলে গেছেন মৃত্যুর ওপারে। স্ত্রীর বনানীর কবরের ভেতরে গত ২৫ ডিসেম্বর আমি, বড় ভাই ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, বোন নিলুফার ও অন্য স্বজনরা ড. আরেফিনকে দাফন করেছি। ড. আরেফিন সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, প্রথমে সমাজতত্ত্ব এবং পরে নৃবিজ্ঞান বিভাগে। ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে ফুল নিয়ে তার মরদেহ দেখতে এসেছিলেন অগুনতি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও গবেষণা সহযোগী। এদের মধ্যে আরও ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠাকরণে মূলত সারথীর ভূমিকা ছিল ড. আরেফিনের। না ফেরার দেশে যাওয়া নিজের ছোট ভাই সম্পর্কে বড় ভাইয়ের কিছু বলা কষ্টকর এবং একই সঙ্গে নৈকট্যের প্রচ্ছন্নতায় সম্ভবত সাধারণভাবে দৃষ্টিলব্ধ তথ্যের অপ্রতুলতা প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। তথাপিও তার এবং আমাদের জীবনের পেছনের দিকে তাকিয়ে অনুধাবনতার বলয়ে বলতে পেরেছিলাম, ড. আরেফিনের সারাজীবন ছিল কপটতা বিবর্জিত, সত্যকথন ও আচরণে উজ্জ্বল, দৃঢ়তায় বিস্তৃত এবং সব রকম নীচতার ওপরে। আজীবন শিক্ষক হিসেবে তিনি কপটতাকে সব সময় দূরে সরিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার কথাগুলো বলে গেছেন, তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে গেছেন। আমার পরিচিতির বলয়ে আমি এমন কারও দেখা পাইনি বা কারও কাছ থেকে শুনিনি যে, তিনি এক জায়গায় এক কথা বলে বা এক রকম আচরণ করে অন্য জায়গায় ভিন্নতর কথা বলেছেন বা আচরণ করেছেন। ঠিক তেমনি মিথ্যাকে দূরে সরিয়ে সত্য যত কঠিন ও অপ্রিয় হোক না কেন তিনি তা বিকৃত বা গোপন করতে কখনও কোন কথা বলেননি, পদক্ষেপ নেননি। একটি বড় পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদের জীবন সব সময় বিত্ত-প্রতুল ছিল না। স্বল্পবিত্তের কর্মক্ষেত্রে প্রায়শই দেখি ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের বিবেচনায় সত্যকথন ও আচরণকে সাময়িকভাবে কেউ কেউ দূরে সরিয়ে দিয়েছেন এবং সততার অনুকূলে মূল্যবোধকে অলঙ্ঘনীয়ভাবে গ্রহণ কিংবা অনুসরণ করেননি। এ প্রেক্ষিতে আমরা, তার ভাই বোন এবং সহযোগী ও সহকর্মীরা প্রশংসার্হ দৃষ্টিতে তার সততাকে অবলোকন করেছি। আমি তার ছেলে ও মেয়েকে এবং আমার দুই সন্তানকে এক্ষেত্রে তার কৃতকর্ম ও কথনকে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে রাখার অনুশাসন দিয়েছি। মানুষ হিসেবে সকলকে মনে করে সকলের প্রতি তিনি সম আচরণ করেছেন এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক কথা বা কর্ম থেকে তিনি নিজকে সযতেœ দূরে রেখেছেন। তিনি স্বল্পভাষী ও প্রচারবিমুখ ছিলেন; কিন্তু তার কথা ও আচরণে সব প্রকার নীচতা দূরে সরিয়ে রেখে চলার দৃঢ়তা আমাদের আকর্ষিত করেছে। কাউকে তার ন্যায়সঙ্গত পাওনা থেকে বঞ্চিত, কারও সম্পত্তির দাবিকে অগ্রাহ্য এবং দুর্বলকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করার কোন কাজ বা কথা আমার এই ভাইটির সরল রৈখিক জীবনে ছায়াপাত করেনি। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন প্রাত্যহিকতার প্রচ্ছন্নতায় তার চরিত্রের এই দিকগুলো আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ছিল না। তার চলে যাওয়ার পর এসব স্মৃতি উজ্জ্বল উপকরণ নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়ে যাচ্ছে। নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের সমাজকে দেয়া তার কতিপয় অবদানের কথা মনে করছি। ড. আরেফিনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, চাঁদপুর, কচুয়া থানার গুলবাহার গ্রামে। তার পড়াশোনার প্রাথমিক পর্যায়ে গুলবাহারে, মাধ্যমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢাকায়, ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাপন হয়েছে। ড. আরেফিন ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সমাজতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে তিনি পছন্দ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ড. নাজমুল করিমকে। ড. নাজমুল করিমের লেখা ‘ফাল্গুনকরা’ বইটি এ দেশের গ্রামাঞ্চলে গত শতাব্দীর প্রথমাংশের বিবর্তনের রূপরেখা হিসেবে তাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আরেক প্রিয় শিক্ষক ড. সাদ উদ্দীন। ১৯৭২ সালে কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বৃত্তি পান। মনে পড়ে বিত্তস্বল্প পরিবারের তরফ থেকে আমরা তাকে যাওয়ার আগে আমাদের আয় থেকে বিমান ভাড়াটিও দিতে সক্ষম হইনি। জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল কবিরকে অনুরোধ করে আমি তার জন্য বিমান ভাড়া ঋণ হিসেবে এনে দিয়েছিলাম। মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সেখানে থেকে পড়াশোনার জন্য যথা প্রয়োজন বৃত্তি দিয়েছিল। আড়াই বছর সেখানে পড়াশোনার পর এমএস ডিগ্রী (১৯৭৬) পেয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়ে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে আমি ও আমার স্ত্রী সীতারা এবং বড় ছেলে জালাল বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবাহিত ছাত্রদের আবাস ওয়ারেন হলে ছিলাম। আরেফিন সিরাকিউজ থেকে বস্টনে বেড়াতে এসে আমাদের সঙ্গে এক কামরায় এক সপ্তাহ ছিলেন। সে সময় দু’কামরাবিশিষ্ট বাসস্থানে থাকার আর্থিক সঙ্গতি আমাদের ছিল না। গভীর রাতে আমি, আরেফিন ও সীতারা যুক্তরাষ্ট্রে দৃষ্ট সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করেছি এবং সেসবের আপেক্ষিকতায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রযুক্তীয় যথার্থ কার্যক্রম জ্ঞানের আলোকে শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছি। বিত্তস্বল্প পরিবেশে জ্ঞান অর্জন ও প্রয়োগের বিমুক্ত আবহে সে সপ্তাহ ছিল সম্ভবত আমাদের জন্য একে অন্যকে জানা ও অনুধাবন করার শ্রেষ্টতম সময়। আরেফিন বস্টন থেকে বিদায় নিয়ে সিরাকিউজে যাওয়ার আগে আমাদের বলেছিলেন যে, উচ্চ শিক্ষার প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমাদের প্রয়োগ ও অনুশীলন করতে হবে। ড. আরেফিন নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কতিপয় বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যা আমার বিবেচনায় এখনও বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে স্থান দিতে সক্ষম হইনি। আংশিকভাবে কচুয়ায় পেরেছি। ড. আরেফিন তার দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীন উন্নয়ন ও কল্যাণের লক্ষ্যে সকল কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সর্বজনকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতার ওপর। কচুয়ার প্রায় ৪ লাখ জনগণের মধ্যে ৪০ হাজার হিন্দু নর-নারীর বাস। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাতে বিচার ও প্রশাসনে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা হিন্দু মুসলমানভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দূরে সরিয়ে সকল মানুষকে সমান অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করি তার প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি প্রণয়নের সময় নৃবিজ্ঞানী ড. আরেফিনের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলেচনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি আদিবাসী ও উপজাতীয়দের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভিন্নতা রক্ষাকরণের যথা প্রয়োজন আইনী প্রতিরক্ষণ চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে, উদাহরণত যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করার দাবি ও যুক্তিতে তাদের জাতীয় জীবনের মধ্যস্রোত থেকে দূরে সরিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের সাধারণ এলাকায় এবং জীবনের মধ্যস্রোত যেসব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান, সেখানে যেসব শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবামূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে এবং আর্থিক ও প্রাযুক্তিক সহযোগিতাকরণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ও ব্যবহৃত হয়েছে তার থেকে তারা দূরে সরে থেকে জীবনকে সমভাবে বিকশিত করার সুযোগ হতে বঞ্চিত রয়েছেন। ড. আরেফিন তার লেখা ও শিক্ষণের মাঝে এই সকল সূত্র সমন্বয়ের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ড. আরেফিন ৬৯ বছর বেঁচে ছিলেন। শিক্ষক জীবনের বাইরে অন্যান্য পেশার আকর্ষণ তাকে শিক্ষকতা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকবার ছুটি নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সেখানকার নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিদদের সঙ্গে ফলপ্রসূভাবে মতবিনিময় করেছেন। তার লেখা নিবন্ধাদি দেশ- বিদেশের বিভিন্ন পেশাগত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত শিমুলিয়া গ্রামের ওপর তার রচিত অভিসন্দর্ভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়ে নৃবিজ্ঞানের পাঠ্য ও সূত্রীয় গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা পেয়ে আসছে। তার অবিস্মরণীয় কথা- সমাজে কেউ পতিতা হয়ে জন্ম নেয় না, সমাজই একজন নারীকে পতিতা করে তোলে- আমাদের সকলের জন্য চেতনাবোধ জাগরিত করার লক্ষ্যে তীব্র কশাঘাত হিসেবে বিবেচনীয়। সমাজকে সংবিধানশীলতার প্রেক্ষিতে জানার ও পরিবর্তন করার তার জীবনব্যাপী সাধনা গত ২৫ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সকল শিক্ষক, সহযোগী ছাত্র ও অনুরাগীরা সমবেত হয়ে নৈতিকভাবে সমর্থন করেছেন। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ ডিসেম্বর প্রেরিত এক শোকবার্তায় ড. আরেফিনের মৃত্যুকে নৃবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে শোক প্রকাশ করেছেন। গত ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ সম্প্রতি প্রয়াত অন্যান্য কৃতবিদ্য ব্যক্তি ও সংসদ সদস্যসহ ড. আরেফিনের মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আমার বিবেচনায় এই ছিল তার জীবনের বড় প্রাপ্তি। লেখক : সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
×