ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

নব রূপায়ণে একুশ শতকের মাইকেল

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

নব রূপায়ণে একুশ শতকের মাইকেল

উই আর ম্যান, বাট ইউ জিস্যু, ইউ গড, ইউ আর নট লাইক আস, বাট ইউ হ্যাড হ্যাঙ্ক মাই ডিয়ার, হেনরিয়েটা ইউ আর নো মোর। হেনরিয়েটা নেই, আমি মাইকেল মধুসূদন’। এভাবেই সংলাপ আওড়াতে আওড়াতে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন ‘একুশ শতকের নতুন মাইকেল’ অনন্ত হিরা। না, নাটকের নাম মাইকেল নয়। অন্তিমকালীন সময়ে অতীতমুখী মাইকেলের বিষণœ অস্থিরতা, গভীর অন্তর্দাহ, সুতীব্র মানসিক যন্ত্রণা আর সেই সঙ্গে দ্রোহ চেতনার সংমিশ্রণে জন্ম নিল মাইকেল বিষয়ক এ যাবতকালের নাট্য সিরিজের একেবারে নব্য উপাখ্যান ‘দাঁড়াও...জন্ম যদি তব বঙ্গে’। বাংলার মধুকবির ১৯৩তম জয়ন্তির পরদিন অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের ১২তম প্রযোজনা হিসেবে এটি মঞ্চায়িত হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। ১৯৩৯ সালে বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদনের’ পর এ জাতীয় আরও কয়েকটি নাটক লেখা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে বিধায়ক ভট্টাচার্য লিখেছেন যাত্রাপালা ‘বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন’। তবে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অনন্ত হিরার ভাবনায় এবং অপূর্ব কুমার কু-ুর রচনায় বাংলার রঙ্গভূমিতে যে ‘মাইকেল’ ভূমিষ্ঠ হলেন-সৃজনে, দর্শনে, বিশ্লেষণে এবং সামগ্রিক উপস্থাপনায় তা একেবারেই অভিনব। অভিনবত্ব এজন্যে যে, প্রচলিত জীবনীমূলক নাট্য রচনার গৎবাধা নীতি নিয়ম এখানে অনুসরণ করা হয়নি। বহু চরিত্র, বহু দৃশ্য এবং অনেক ঘটনা-পার্শ্বঘটনায় ভারাক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ নাটক থেকে এর চরিত্র সংখ্যা মাত্র ৩, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন ও হেনরিয়েটা। অভিনয়ের সময় সীমা মাত্র ১ ঘণ্টা ১৪ মিনিট। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন। রোগ শয্যায় মাইকেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবনের সব রং মুছে যাবে। এই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তটাকেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন নাট্যকার এবং বলতে হবে লক্ষ্য তার অব্যর্থ; অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য, নাটক, প্রহসন, পত্রকাব্য, চতুর্দশপদী- এসব সৃষ্টিসম্ভারের একচ্ছত্র সম্রাট মাইকেল মধুসূদনের যাপিত জীবনের বিশাল ক্যানভাসকে এক স্বপ্নঘোরের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে নিয়ে আসাকে এক চাতুর্যপূর্ণ নাট্যক্রিয়ার শৈল্পিক প্রকাশ বলা যায়। সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী নাট্যমঞ্চায়নে প্রাঙ্গণেমোরের আসনটি খুবই স্বতন্ত্র। অভিনয় কর্মেও তাদের বিশিষ্টতা সুধীজনের দৃষ্টি কাড়ে। যেটি আবার নতুন করে দেখা গেল ‘দাঁড়াও... জন্ম যদি তব বঙ্গে’ নাটকে। নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী, নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী এবং বাংলাদেশে নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন অভিনয় আঙ্গিকে মাইকেলকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদেরই উত্তরসূরি অনন্ত হিরা সমকালকে মাথায় রেখে একেবারে নিশ্চিতরূপে পরিবর্তিত শিল্প আঙ্গিকে মাইকেলকে পৌঁছে দিয়েছেন জীবনের গভীরতায়। বিদ্যাসাগরের রূপসজ্জায় রামিজ রাজু আসার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের আবহ আর একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যেন। দর্শক নড়ে চড়ে বসেন। একপর্যায়ে দেখা যায় বিদ্যাসাগরীয় সংলাপের সঙ্গে রামিজ রাজু একেবারে মিলেমিশে যান। দর্শককে টেনে নিয়ে যান পুরোপুরি। প্রতিনিয়ত নব নব চরিত্রের অন্বেষায় ব্যাকুল রামিজ রাজু এই চরিত্রে আরেকটি নতুন মাত্রা দেখিয়ে গেলেন। এই নাটক দেখতে দেখতে কিছু প্রশ্ন জেগেছে মনে। যেমন হেনরিয়েটার প্রতি নাট্যকার ও নির্দেশক এত নির্দয় কেন? চরিত্রটিকে কি আর একটু বাড়ানো যায় না? মাইকেলের যন্ত্রণাদীর্ণ ও ট্র্যাজিক জীবনের এক মমতাময়ী চরিত্র হেনরিয়েটা। নূনা আফরোজের মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনা খুবই বাস্তবানুগ হয়েছে। রামিজ রাজুর আবহসঙ্গীত মিলনায়তনপূর্ণ দর্শককে এক মুগ্ধ স্তব্ধতার দিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নির্দেশনার ক্ষেত্রে বলা যায় নাটকের শুরুতে এবং বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথোপকথনে কিছু মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সামান্য কিছু অসঙ্গতি দেখা গেলেও মঞ্চায়ন অব্যাহত থাকলে তা কেটে যাবে। সবশেষে নাট্যকার ও নির্দেশকের কাছে দাবি : শিশুপুত্র মধুসূদনকে যিনি রামায়ণ মহাভারত শোনাতেন, বাংলাদেশের অনেক গল্প, কবিতা সুর করে পড়াতেন-সেই মধুজননী জাহ্নবীকে চরিত্রলিপিতে কি আনা যায় না? কারণ এসব ব্যতিক্রমী মঞ্চায়নে নূনা আফরোজের মতো সৃষ্টিশীল অভিনেত্রীর অনুপস্থিতি দর্শকদের জন্য কিছুটা হলেও কমতি।
×