ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতি

লোকসান পিছু ছাড়ছে না

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

লোকসান পিছু ছাড়ছে না

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বিআইডব্লিউটিসির সর্বপ্রথম কেনা জাহাজ ‘এমভি সোনারগাঁও’-এর মতোই বিপুল পরিমাণ টাকা লোকসান দিয়ে অচল জাহাজের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে ‘এমভি বাঙালি’। সংস্থার গলার কাঁটা অপসারণ করার মতোই ‘এমভি বাঙালি’কে ভাড়া দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডব্লিউটিসির ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্মিত জাহাজ ‘এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতি’ শুরু থেকেই লোকসানের কারণে যাত্রী পরিবহন না করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়েই পরিচালনা শুরু হয়। এতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট কোটি টাকারও বেশি। বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ জাহাজ দুটির চেয়ে এখনও সংস্থার ৮০ বছরের পুরনো প্যাডেল স্টিমারগুলো কম খরচে যাত্রী পরিবহনে সক্ষম বলে জানিয়েছেন নৌযান চালকেরা। বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দেয়ার পর এমভি বাঙালির জন্য কোনরকমে উপায় খুঁজে বের করা হয়। ওই জাহাজটি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটক পরিবহনের জন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সম্প্রতি ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিমাসে ভাড়াবাবদ সংস্থাকে ১২ লাখ টাকা প্রদান করবে। এরমধ্যে নৌযানটিতে কর্মরত ক্রুসহ ৩৭ স্টাফের বেতন-ভাতা বাবদ সংস্থার খরচ হবে পাঁচ লাখ টাকা। নতুন নির্মিত যে জাহাজ, যাত্রী পরিবহনে গেলেই প্রতি রাউন্ড ট্রিপে দেড় লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়, সেটির জন্য এমন উপায় খুঁজে পেয়ে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা অনেকটা স্বস্তি পেলেও বাস্তবতা তাদের কতটা স্বস্তিতে রাখবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ১৫ মার্চের পর আর কোন নৌযান চলাচলের অনুমতি নেই। তার ওপরে যে রুটে পরিচালনার জন্য ‘এমভি বাঙালি’ ভাড়া দেয়া হয়েছে, সে রুটে এখনও যাত্রী পরিবহনের অনুমতি মেলেনি বলে জানিয়েছেন ইজারাদারের কর্মচারীরা। চুক্তি অনুযায়ী অনুমতি পাওয়ার আগে জাহাজ বুঝে নেয়া কিংবা ভাড়া পরিশোধে বাধ্য নয় ইজারাদার। সূত্রমতে, ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল ‘এমভি বাঙালি’ ও পরের বছর ১৪ জুলাই ‘এমভি মধুমতি’ যাত্রী পরিবহনের জন্য উদ্বোধন করা হয়। জাহাজ দু’টির নির্মাণকাজ যাত্রীবান্ধব হয়নি। কয়েকগুণ বেশি জ্বালানি খরচ হওয়ার কারণে কর্মকর্তারা হয়েছেন হতবাক। সংস্থার ৮০ বছরের পুরনো একেকটি রকেট স্টিমার ৯৬০ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম ও পুরনো প্যাডেল নৌযানগুলোতে ঘণ্টায় জ্বালানি ব্যয় হয় ৯৫ লিটার। নতুন ‘এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙালি’ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম সাড়ে সাত শ’। অথচ নতুন প্রতিটি জাহাজে জ্বালানি পুড়ছে ঘণ্টায় দুই শ’ লিটার। লোকসান ঠেকাতে উদ্বোধনের পর যাত্রী পরিবহন না করে জাহাজ দুটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এ নিয়ে সমালোচনা ও দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলে জাহাজ দুটি লোকসান দিয়েই যাত্রী পরিবহনে যুক্ত করা হয়। তাতে গত বছরের জুন পর্যন্তলোকসান হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। নৌযান দু’টির ক্রু’সহ ৭০ স্টাফের বেতন-ভাতা বাবদ আরও সাড়ে তিন কোটি টাকা সংস্থার কোষাগার থেকে খরচ করতে হয়েছে। গত বছর জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সাত মাসে নৌযান দুটি পরিচালনা করতে সংস্থার কোষাগার থেকে আরও এক কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। যে পরিমাণ জ্বালানি খরচ হচ্ছে তাতে লোকসান এড়াতে কারিগরি বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে নৌযান দু’টি স্বল্প দূরত্বে অধিক যাত্রী বহনে নিয়োজিত করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সংস্থার কর্মকর্তারা করছেন উল্টো কাজ। বাঙালিকে ভাড়া দেয়া হলেও ‘এমভি মধুমতি’কে আরও দূরবর্তী ঢাকা-খুলনা রুটে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে এখন ‘মধুমতি’কে লোকসান দিতে হচ্ছে চার লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিসির জন্মের পর এ জাহাজ দু’টি নির্মাণ ছাড়া আগে নয় কোটি টাকায় রেলওয়ের জাহাজ ‘এমভি সোনারগাঁও’ সংগ্রহ করেছিল। ওই জাহাজটি মেরামত ও পুনর্বাসনে বিআইডব্লিউটিসি ব্যয় করে ১১ কোটি টাকা। কিন্তু সেটিও যাত্রীবান্ধব করতে না পেরে বাঙালির মতোই শুরুতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে যুক্ত করা হয়। পরে আরও বিপুল টাকা লোকসান দিয়ে সোনারগাঁওকে ভাসমান রেস্তরাঁ হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। সোনারগাঁওকে যাত্রী পরিবহনযোগ্য করতে ২০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হলেও নৌযানটি যাত্রী পরিবহনের পরিবর্তে ঢাকার শ্যামপুরের কাছে ভাসমান রেস্তরাঁ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, ঢাকা-বরিশাল রুটে বেসরকারী কোম্পানির নৌযান মালিকরা একেকটি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল লঞ্চ নির্মাণ করতে ব্যয় করেন ১৫ থেকে ১৮ কোটি টাকা। সরকারি সংস্থার একেকটি জাহাজ নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা খরচ হলেও তা কেন যাত্রীবান্ধব হয় না এ নিয়ে সর্বত্রই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নতুন জাহাজগুলো ত্রুটিপূর্ণ ও ব্রিটিশ আমলের তৈরি পুরনো প্যাডেল স্টিমার কোনভাবেই যাত্রী পরিবহনের প্রতিযোগিতায় বেসরকারী লঞ্চগুলোর সঙ্গে টিকতে পারছে না। গত বছরের জুলাই মাসে বেসরকারী লঞ্চের সঙ্গে মুখোমুখী সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্যাডেল রকেট স্টীমার ‘পিএস মাহসুদ’। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ডে রয়েছে পিএস মাহসুদ। ডক ইয়ার্ডে পাঠানো জরুরী হয়ে পড়েছে ‘পিএস অস্ট্রিচ’কে। এ নৌযানটিরও তলা ও উপরি কাঠামোর মেরামত ও সিøপওয়ের সমস্যার কারণে আগামী এক মাসের মধ্যে ডকিং করার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার পরিচালক (বাণিজ্য) জানান, পিএস মাহসুদ যাত্রী পরিবহনের জন্য খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে। পিএস অস্ট্রিচ ডকিং করার পর তেমন কোন সংকট থাকবে না। তিনি আরও জানান, সংস্থার আরও নতুন জাহাজ যুক্ত করা হবে। যাত্রী দুর্ভোগ এড়াতে সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তাদের নানামুখী চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
×