ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আশঙ্কাজনক হারে মাতৃমৃত্যু হার বাড়ছে ॥ তথ্য খোদ অধিদফতরের

অল্প বয়সে বিয়ে আর কিশোরী মায়ের সংখ্যা কমছেই না

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩০ জানুয়ারি ২০১৭

অল্প বয়সে বিয়ে আর কিশোরী মায়ের সংখ্যা কমছেই না

নিখিল মানখিন ॥ অল্প বয়সে বিয়ে ও সন্তানধারণকারী কিশোরীর সংখ্যা কিছুতেই কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। অথচ কৈশোরে যারা মা হচ্ছে, তাদের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। আর শিশুমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ বেশি। বিশ্বের যেসব দেশে কিশোরীদের গর্ভধারণের হার বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এ দেশের মহিলাদের প্রায় অর্ধেকের বিয়ের সময়ে বয়স ১৮ বছরের কম থাকে আর শতকরা ৫৮ ভাগ ২০ বছর বয়সের আগেই প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়। এ বয়সের জন্য যথাযথ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ অপর্যাপ্ত। ফলে দেশে প্রতি হাজার শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২ দশমিক ৯ জন মা মারা যান। তাদের মধ্যে কিশোরী মায়ের সংখ্যাই বেশি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ‘মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য’ বিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। পরিবার পরিকলল্পনা অধিদফতর জানায়, মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সফল করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জোরালো করতে হবে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক হার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচী বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতা শতকরা গড়ে ১ দশমিক ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার শতকরা ৫৫ দশমিক ৮ ভাগে উন্নীত হয়েছে। প্রজননহার বা মহিলাপ্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার কমে বর্তমানে ২ দশমিক ৭ ভাগে নেমেছে। বর্তমানে প্রজননক্ষম সকল দম্পতি পরিবার পরিকল্পনার কোন না কোন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ১৯৭৫ সালের ৭.৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৬১.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার সন্তোষজনক হারে বাড়েনি। ১৭.৬ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অপূর্ণ চাহিদার ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলাদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১৯.৮ শতাংশ। এ বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় আর বিবাহিতদের মধ্যে কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন শতকরা ৬৪ দশমিক ৩ ভাগ। এ হিসাবে দেশের ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়। শহরের তুলনায় গ্রামে কিশোরী মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। রাজশাহী বিভাগে এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শতকরা ৩২ দশমিক ৮ ভাগ এবং সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯ দশমিক ৭ ভাগ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়, যাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই ইতোমধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগই ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী, যাদের মধ্যে আবার ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয় ৬৬ শতাংশের। এসব কিশোরীর আবার এক-তৃতীয়াংশ এবং ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সে তিন-চতুর্থাংশ কিশোরী সন্তানধারণ করেন। স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ৭ ভাগ স্থায়ী এবং ৮ দশমিক ৬ ভাগ দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের পদ্ধতি গ্রহণের হার এখনও অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ পুরুষ স্থায়ী এবং অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। সূত্রমতে, এখনও ৮৫ শতাংশ মায়েরই বাড়িতে ঝুঁকির মধ্যে প্রসব করানো হচ্ছে। মাত্র ১৫ শতাংশ মা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সন্তান প্রসব করানোর সুযোগ পান। সরকারী হিসাবেই প্রতি লাখ জীবিত সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ২৯০ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। তবে বেসরকারী সংস্থাগুলোর মতে, মাতৃমৃত্যুর হার আরও অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০১৭ সালের মধ্যে এক লাখ জীবিত সন্তান জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৪৩-এ নামিয়ে আনতে হবে। ৪৬ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তশূন্যতায় ভোগেন। গর্ভকালীন বা প্রসব জটিলতার কারণে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নারী দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩.১ মিলিয়ন (৩১ লাখ) প্রসব সংঘটিত হয়, যার প্রায় ৩৭.৪ শতাংশ (১১লাখ) প্রসব হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পরপরই মাকে যদি প্রসবপরবর্তী পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনা যায় তাহলে একদিকে যেমন অনিচ্ছাকৃত ও পুনরায় গর্ভধারণ এড়ানো সম্ভব, তেমনি দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী পদ্ধতি বিশেষ করে টিউবেকটমি ও আইইউডি গ্রহীতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সক্ষম দম্পতিদের ক্ষেত্রে দু’সন্তানের মাঝে ন্যূনতম (৩ বছর) বিরতি এবং দুই জীবিত সন্তানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির বয়স কমপক্ষে এক বছর হলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করাই এবারের সেবা ও প্রচার সপ্তাহের মূল লক্ষ্য। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির গ্রহীতা বৃদ্ধি মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে সরাসরি প্রভাব রাখতে সক্ষম। প্রসবের পর প্রথম ১২ মাসের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত ও স্বল্প বিরতিতে পুনরায় গর্ভধারণ হতে বিরত থাকাই হলো প্রসবপরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা। এর কৌশলগত দিক হলো, প্রসবের পর উপযুক্ত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ অথবা দুটি সন্তান জন্মদানের মধ্যবর্তী সময়ে একজন নারীর ইচ্ছানুযায়ী প্রয়োজনীয় বিরতি প্রদান (কমপক্ষে ৩ বছর) অথবা সন্তান জন্মদান সীমিতকরণ। এতে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০১২ এবং এইচপিএনএসডিপি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সিপিআর ৭২ শতাংশে উন্নীত এবং টিএফআর ২.১ অর্জন করার পথ সহজতর হবে।
×