ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আসাদুজ্জামান চৌধুরী

দায়িত্বকে ছোট করে দেখা উচিত নয় ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৭

দায়িত্বকে ছোট করে  দেখা উচিত নয় ॥ অভিমত

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। প্রযুক্তি আর উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছে মানুষ। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে বর্তমান সরকার। তবে অপশক্তিও বসে নেই। খুব কৌশলে তারা সরকারের বিশ্বাসভাজন হয়ে শেকড়ে প্রবেশ করে নীরব ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে তা যেন সকলের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে তারা। তবে সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক আর রাজনৈতিক গভীর বিশ্লেষণে তা দৃশ্যমান হয়েও কোন এক রহস্যজনক কারণে অদৃশ্যমান থেকে যাচ্ছে। তার কারণ খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না অথবা অদৃশ্যমান শক্তি সুকৌশলে তা হতে দিচ্ছে না। এছাড়া দেশী-বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্র বিভিন্নভাবে কাজ করছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে যে গবেষণা হতে পারে তার পরিবেশও এখন তৈরি করা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। কাজের সুবিধার জন্য কর্তৃত্ব অন্যকে প্রদান করা যায়। আর কর্তৃত্ব প্রদানের বিষয়টি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত হতে পারে। এটি একটি বিশ্বজনীন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কর্তৃত্ব প্রদান করা গেলেও দায়িত্বকে প্রদান করা যায় না। কর্তৃত্ব প্রদান করার আগে দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। তাই কাউকে কর্তৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার সক্ষমতা রাখে কিনা তা বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই করা প্রয়োজন। আবার কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বেশি বা কম প্রদান করা হলে কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। জবাবদিহিতার বিষয়টি কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে যখন আধুনিক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে ঠিক তখনই পাঠ্যপুস্তকের এই বিতর্ক কিছুটা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বিরামচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। বইগুলোর মধ্যে টেকনিক্যাল ভুলগুলো হয়ত শুদ্ধ করা যেতে পারে; কিন্তু আদর্শগত যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি রয়েছে তা কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসাম্প্রদায়িক’ চেতনার যে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবার তার ঠিক বিপরীত মেরুকরণ ঘটেছে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে। সেখানে সাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী যে ব্যক্তিবর্গকে এই বইগুলো লেখা ও সম্পাদনার কর্তৃত্ব প্রদান করেছিলেন তারা সেই কর্তৃত্ব অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন যে প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে তা হলো শর্ষের ভেতর কোন ভূত লুকিয়ে ছিল কিনা। তাহলে জঙ্গীবাদী ও উগ্রপন্থীরা সুকৌশলে বর্তমান সরকারের উন্নয়নধারাকে ব্যাহত করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রেও তাদের পদচারণা শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলছিল পাঠ্যপুস্তকে এই ধরনের বৈপরীত্য এক ধরনের পশ্চাদমুখিতা। ৩৬ কোটি ২১ লাখ নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এ ধরনের আদর্শচ্যুতির কারণে তা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে অথবা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। অনেকে বলছেন টেকনিক্যাল ভুলগুলো শুদ্ধ করা সম্ভব। সেটা হয়ত সম্ভব; কিন্তু একজন শিশুকে যখন এই পাঠ্যপুস্তকগুলোর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত শুরু হয়েছে তা কোনভাবেই অবজ্ঞা করা যায় না। কেননা নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে সমঝোতা করলে ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমগ্র জাতিকে গ্রাস করবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই পাঠ্যপুস্তকগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বাধীনতার চেতনায় নতুন পাঠ্যপুস্তক শিশুদের হাতে তুলে দেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে সম্পাদনা পরিষদের অনেকেই অস্বীকার করছেন তাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো ছাপানোর আগে দেখানো হয়নি। এটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত উন্মোচন করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলছেন। শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী সকলেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অপশক্তি সুকৌশলে আত্মগোপন করে আছে তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে এ ধরনের অনভিপ্রেত একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই শক্তির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সরকারকে বিব্রত করে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করা ও তাদের প্রভুদের ক্ষমতায় বসানো। কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের বিষয়গুলো যে গুরুত্বপূর্ণ তা অগ্রাহ্য করাই এ ধরনের ঘটনার অবতারণা ঘটছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটি হলো কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। সময়ের সঙ্গে একজন মানুষের পরিবর্তন ঘটছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কারণ, একজন মানুষ হয়ত মানুষ হিসেবে থেকে যায়, তবে তার মনের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কর্তৃত্ব এবং দায়িত্বের বিষয়টি চিন্তা করা প্রয়োজন। এর কারণ হলো ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারের চারপাশ ঘিরে আছে। তাই এক্ষেত্রে কোনভাবেই আপোস করলে চলবে না। কেননা শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই শেখ হাসিনা। দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে বিপরীত ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটানোর জন্য ইতোমধ্যেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু এই পদ্মা সেতু নিমার্ণের আগেই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রচার চালাতে থাকেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোবলকে ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নধারা বিনষ্ট করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি এখানে ঘটেছে তা হলো তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে পদত্যাগ করেন, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। কেউ পদত্যাগ করুক তা দেশবাসী চায় না। নাগরিকদের একটি চাওয়া, তা হলো যে কর্তৃত্ব যাকে দেয়া হয়েছে সে তার দায়ভার সঠিকভাবে পালন করছে কি-না তা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা, যাতে করে বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করার জন্য দৈত্যরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এক্ষেত্রে দেশবাসীর একমাত্র আশা-ভরসার স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবেÑ তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তা হলেই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
×