ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোসাইন ইমরান

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ মুক্তবুদ্ধি চর্চায় জাগরণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ মুক্তবুদ্ধি চর্চায় জাগরণ

বর্তমান সময়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জঙ্গীবাদ। বিভিন্ন সময় ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগ এনে দেশের মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের ওপর বর্বরোচিত হামলার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করার অশুভ পাঁয়তারা করে আসছে নানা নামে জঙ্গীগোষ্ঠী। আর এসব ন্যক্কারজনক কাজে না বুঝেই বর্তমান তরুণ সমাজের কেউ কেউ নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে এই চক্রে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি জঙ্গী হামলার ঘটনায় এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যেসব শিক্ষার্থীর সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব গঠনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করার কথা, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ তারাই দেশ ও জাতিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে লিপ্ত। তরুণ সমাজকে এই বিপথগামী পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের উর্ধতন মহল থেকে দেশের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর বেশ কয়েকটি নির্দেশনা প্রেরণ করেছে। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ১৯৯১ সাল যাত্রা শুরুর পর থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ৩২০ একরের এ ক্যাম্পাসে রয়েছে মোট ৫৯টি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশ ও জাতি গঠনে দেশপ্রেমিক, নেতৃত্বসম্পন্ন আলোকিত মানুষ তৈরি করার। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আজকের এই আয়োজন। দিক থিয়েটার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যমত মাধ্যম হচ্ছে নাটক। নাটকের মাধ্যমে সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা যায়। এ লক্ষ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যতম নাট্য সংগঠন ‘দিক থিয়েটার’। ‘নাটকে সাম্যের আন্দোলন, জীবনের ভাষায় মুক্তি অন্বেষণ’ এই সেøাগানকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। দিক থিয়েটারের সভাপতি তনু দ্বীপ বলেন, ‘নাটক মানেই নিছক কোন বিনোদন নয়, বরং নাটক মানে নতুন স্বপ্ন, নতুন দিন। দিকের প্রতিটি নাটকই একটা বিশেষ কোন বার্তাবাহী আন্দোলন অথবা স্বপ্ন। তাই সমাজকে পরিবর্তনের প্রত্যয়ে নতুন প্রত্যাশা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে আমরা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি।’ মাভৈ আবৃত্তি সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা প্রায় সকল শিক্ষার্থীই কোন না কোনভাবে আবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকে। কেউ বা আবৃত্তি শুনে। আবার কেউ বা আবৃত্তি করে। শাবি ক্যাম্পাসে ১৯৯৮ সালের ১৫ নবেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাভৈ আবৃত্তি সংসদ’ নামে একটি আবৃত্তি বিষয়ক সংগঠনের। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি শাবি ক্যাম্পাসে সফলতার সঙ্গে সুদীর্ঘ ১৮ বছর পার করেছে। আবৃত্তি, শ্রুতিনাটক, উপস্থাপনা, জাতীয় দিবস উদযাপন, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ, আবৃত্তি কর্মশালা, বর্ষপূর্তি ও নবীনবরণসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে সংগঠনটির উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। মাভৈ আবৃত্তি সংসদের সভাপতি কাসিব মুন্না বলেন, ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সদস্য হিসেবে কবিতাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য এবং আমরা সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছি।’ চোখ ফিল্ম সোসাইটি ছোটবেলায় কালজয়ী সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে অনেকের মনের মধ্যে সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছা জন্মে। শিক্ষার্থীদের মনের সেই লুকায়িত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে শাবি ক্যাম্পাসে ১৯৯৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় চোখ ফিল্ম সোসাইটি নামে একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠনের। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মশালা, পাঠচক্র, দেশী-বিদেশী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। সংগঠনের সভাপতি দীপংকর কপিল দে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমরা প্রতিষ্ঠার পর থেইে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছি।’ নোঙ্গর বর্তমান তরুণ সমাজের বেশিরভাগ অংশ গান হিসেবে ব্যান্ড কিংবা মেটাল ব্যান্ড পছন্দ করে। সঙ্গীত জগতে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে ২০০৩ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নোঙ্গর’ নামে একটি সঙ্গীত সংগঠনের। শুরু থেকে ৪টি শাখায় বিভক্ত হয়ে কাজ করে আসছে সংগঠনটি। এগুলো হচ্ছে নোঙ্গর মিউজিক স্কুল, নোঙ্গর মেটাল ফ্যান ক্লাব, নোঙ্গর ফর হিউমেনিটি সেইক, নোঙ্গর ভিজুয়াল আর্ট। তাছাড়া ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রথম সারি ব্যান্ড দলগুলোকে নিয়ে কনসার্টের আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। সাস্ট সাহিত্য সংসদ ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাস্ট সাহিত্য সংসদ’ নামে একটি সাহিত্যবিষয়ক সংগঠনের। বই, সাহিত্য আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনে দূরদর্শী কা-ারি তৈরি করা যাদের লক্ষ্য। ক্যাম্পাসের সাহিত্যপ্রেমী শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতি মাসেই সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করে সংগঠনটি। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিদেশী সাহিত্যেরও নানা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা সাহিত্যিকের জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রতি মাসেই এ আড্ডার আসর বসে। ফলে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরস্পরের আলাপচারিতায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে প্রতিটি আড্ডা। দ্বার খুলে নতুন জ্ঞানের। ক্যারিয়ার ক্লাব বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থীই নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ সচেতন। সকলেই নিজের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়। আর এসব শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিতে ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১৫ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘ক্যারিয়ার ক্লাব’। বর্তমান চাকরির প্রতিযোগিতার বাজারে কীভাবে পড়াশোনা করলে অন্যদের সঙ্গে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেসব নির্দেশনা দিয়ে থাকে সংগঠনটি। সদস্যদের নিয়ে প্রতি ১৫ দিন পর পর ‘বিসিএস ও ‘জিআরই’ প্রস্তুতি নিয়ে ‘স্টাডি সার্কেলের আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু বাংলাদেশের চাকরির জগতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছেন তাদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘ক্যারিয়ার টক’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংগঠনটি। কিন শাবি ক্যাম্পাসের একদল স্বপ্নবাজ তরুণ যাদের স্বপ্ন ছিল আশপাশের গরিব, অসহায়, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য কিছু একটা করা। সেই স্বপ্নকে পূরণ করতে কিছু স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিন’। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পথচলা ও কাজের পরিধি বাড়িয়েছে সংগঠনটি। ‘কিন’ এর সঙ্গে যুক্ত সকলেই স্বপ্ন দেখেন সমাজে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ বলে কোন শব্দ থাকবে না। আর সেইদিনটি না আসা পর্যন্ত চলবে ‘কিন’ এর নিরন্তর পথচলা বলে জানালেন কিনের সভাপতি নিশান খানদানি। তাছাড়া নিজেদের প্রচেষ্টায় ‘কিন’ স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যাম্পাসের আশপাশের অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকেন এ সংগঠনের কর্মীরা। শীতার্থদের মধ্যে শীতবস্ত্রও বিতরণ করে সংগঠনটি। ট্যুরিস্ট ক্লাব নিয়মতি ক্লাস-পরীক্ষায় যখন মনে চলে আসে ক্লান্তি কিংবা একগুঁয়েমিতাÑ তখন মনকে ফ্রেশ করে নতুনভাবে শুরু করতে সবাই চায় বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। সেইসব শিক্ষার্থীর কথা মাথায় রেখে শাবি ক্যাম্পাসে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ভ্রমণবিষয়ক একটি সংগঠন ‘ট্যুরিস্ট ক্লাবে’র। শিক্ষা, শান্তি, ঐক্য, ভ্রমণ’ সেøাগানকে ধারণ করে এর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। দেশের ভেতরে জাতীয় ট্যুর আয়োজনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ট্যুরের আয়োজন করে থাকে এ সংগঠনটি। বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ নানা দেশে আন্তর্জাতিক ট্যুর সম্পন্ন করেছে এ সংগঠনটি। স্পোর্টস সাস্ট পড়াশোনার পাশাপাশি মন ও শরীর সুস্থ রাখতে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিহার্য। আর এজন্য ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে খেলাধুলার আয়োজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে মাতিয়ে রাখতে ২০০৫ সালে ১৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় ‘স্পোর্টস সাস্ট’ নামে একটি সংগঠনের। খেলাধুলার আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সতেজতা, সম্প্রীতি তৈরি করা এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য বলে জানালেন সাবেক সভাপতি হিমেল রাফি। বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে এ সংগঠন ইনডোর ও আউটডোর গেমের আয়োজন করে। ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, সাইবার গেমসহ সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহণে বিভিন্ন খেলাধুলারও আয়োজন করে থাকে এই সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও নাট্য সংগঠন ‘দিক থিয়েটার’ এর উপদেষ্টা আলামিন রাব্বি বলেন, ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবিকগুণ জাগিয়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কাজের বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে আমাদের তরুণ সমাজকে জঙ্গীবাদ থেকে মুক্ত রাখা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের উচিত এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রমকে সচল রাখতে আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করা।
×