ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উলের আবিষ্কার ১০ হাজার বছর আগে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

উলের আবিষ্কার ১০ হাজার বছর আগে

শীত নিবারণ করতে সবার প্রথম পছন্দ উলের কাপড়-চোপড়। কিন্তু আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ফ্যাক্টরিতে তৈরি এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা উলের মসৃণ শাল-সোয়েটারসহ বিভিন্ন ধরণের গরম কাপড়-চোপড়ের প্রসার ঘটায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে হাতে তৈরি উলের পোশাক। যা এখন রূপকথার গল্পে পরিণত হয়েছে। যেদিন চলে যায় সেদিন আর ফিরে আসে না বা ফিরিয়ে আনা যায় না। এ কথাটা রূঢ় বাস্তব ও নিখাদ সত্য। তেমনই হাতে উল বোনার সোনালী দিনগুলো এখন অতীত। যা হয়ত আর কোনদিন ফিরে আসবে না। অনেকে ভুলেও গেছে হাতে উলের পোশাক তৈরির কাজ। একটা সময় ছিল শীত এলে বাঙালীর ঘরে ঘরে বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি, বৌঝি নানা রঙের উলের বল নিয়ে বাঁশের চিকন কাঠি হাতে নিকানো উঠানে বসে পড়েছে শীতের পোশাক তৈরিতে। শীত এলে উলের হাত-মোজা, পা-মোজা, টুপি, মাফলার, সোয়েটার ও শাল তৈরির ধুম পড়ে গেছে পাড়ায়-পাড়ায়। শীতের আগেই হাতে বোনা উলের পোশাক তৈরির তোড়জোড় শুরু হয়েছে বাড়ি-বাড়ি। যেন প্রতিযোগিতা চলেছে নারীদের মধ্যে। এখন আর হাতের তৈরি উলের পোশাক তেমন একটা দেখা যায় না। উল বোনার সেই সোনালী দিন এখন অতীত। এখন আর বাড়ি-বাড়ি বৌঝিদের উলের বল হাতে বাঁশের চিকন কাঠি নিয়ে বিকেলের রোদে দাওয়ায় বসতে দেখা যায় না। শখের বশে দু’এক বাড়ির মেয়ে তাদের প্রিয়জনদের জন্য উলের শৌখিন পোশাক হাতে বুনে থাকে। শীতের প্রকোপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বা শীত তাড়াতে হাতে তৈরি উলের হাত-মোজা, পা-মোজা, টুপি, মাফলার, সোয়েটার ও শালের প্রচলন উঠেই গেছে। এখনও মাদারীপুর জেলার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বিশেষ করে গ্রাম-গঞ্জে কিছু কিছু বাড়ির বৌঝিদের উলের সোয়েটার, মাফলার, মেয়েদের ফুলহাতা ব্লাউজ, হাতকাটা ব্লাউজ, বিভিন্ন ডিজাইনের পূজার আসন, পুরুষদের চাদর, মেয়েদের চাদর ও শিশুদের টুপি বুনতে দেখা যায়। বাজার থেকে উল, উলের বল ও পরিত্যক্ত উলের ফুলহাতা সোয়েটার কিনে তা থেকে উল খুলে শীতের পোশাক তৈরি করেছেন শহরতলীর সুরঞ্জনা বিশ্বাস, দক্ষিণপাড়ার সাধনা দাস, আল্পনা কুন্ডু, মাধুরী কুন্ডু, অঞ্জু নন্দী, গোপালপুরের নন্দিতা গোস্বামী, ছায়া সাহা, আমগ্রামের রুবি বিশ্বাস। এরা উলের কাজ শিখেছেন মা-কাকিদের কাছ থেকে। এদের মা-কাকিরা শিখেছেন শাশুড়ি ও মায়েদের কাছ থেকে। শীত এলে সংসারের কাজের ফাঁকে কুশিকাঁটা আর উলের বল হাতে গল্পগুজব করতে করতে তারা নিপুণ হাতে তৈরি করতেন উলের পোশাক। এসব তৈরিতে বেশি পারদর্শী সুরঞ্জনা বিশ্বাস। উলে রং করে এ সব জিনিসে আনতেন বৈচিত্র্য। প্রকৃতির নানা চিত্র তুলে ধরে এসব পোশাক-আশাক করে তুলতেন আকর্ষণীয়। আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে উল আবিষ্কৃত হয়। তবে এনিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রথমে আরবের যাযাবররা উল ইউরোপে নিয়ে যায়। কারও কারও মতে, এটি এসেছে পার্সিয়ানদের কাছ থেকে। সর্বশেষ ধারণা, উলের তৈরি পোশাকের উৎপত্তি খ্রিস্টের জন্মের বহুপূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে। পরে এটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মাধ্যমে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে। উলের ব্যবহার সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ইরানের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে। সম্ভবত লৌহযুগে হাতে তৈরি উলের পোশাকের প্রচলন ছিল। রোমান যুগে উল, লিনেন ও চামড়ার পোশাকের প্রথম প্রচলন ঘটে ইউরোপে। মধ্যযুগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে উলের ব্যবসা শুরু হয়। ইংল্যান্ডে প্রথম উল ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠিত হয় ৫০ খ্রিস্টাব্দে উইনচেস্টারে। উদ্যোক্তা ছিল রোমানরা। ১৭৯৭ সালে ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়ায় ১৩টি মেরিনো ভেড়া নিয়ে উলের ফ্যাক্টরি তৈরি করে। এই মেরিনো ভেড়ার লোম থেকেই তৈরি হয় উন্নতমানের উল এবং তাতে তৈরি হয় পাতলা উলের পোশাক। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উল উৎপাদনকারী দেশ অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। উলের পোশাকের আবির্ভাব শীত প্রধান দেশে উষ্ণতা প্রদানের লক্ষ্যে হলেও ফ্যাশনেবল প্রোডাক্ট হিসেবে এর যাত্রা শুরু ১৯ শতকে। প্রথম এমনটি দেখা যায় ১৮২৪ সালে ডাচ ম্যাগাজিন পেনিলোপিতে, যা ছিল উলের ক্রোসেট প্যাটার্নে তৈরি। পোশাক ছাড়াও উলের তৈরি লেইস ১৯ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্সে প্রচলিত হয় এবং ১৮০০ সালে তা চীন, ইরান, উত্তর আফ্রিকা, ভারতসহ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে উলের পোশাক হাতে বোনা হলেও পরবর্তীকালে মেশিন আবিষ্কারের ফলে অনেক জটিল প্যাটার্নের পোশাক তৈরি সহজ ও দ্রুত হয়ে যায়। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×