ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নেই মমতা মাখা হাতে বোনা সোয়েটার

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

নেই মমতা মাখা হাতে বোনা সোয়েটার

উল কাঁটা, বাঙালী নারীর হাতের অলঙ্কার। যুগ যুগ ধরে সব বয়সী, সব শ্রেণীর নারী হাতের সূক্ষ্ম কারুকাজে সোয়েটার, গেঞ্জি, মোজাসহ শীতের নানা পোশাক বুনে এসেছে। চমৎকার সেসব ডিজাইন। বাহারি রঙ। পছন্দের মানুষের গায়ে সে সব মানিয়েও গেছে দারুণভাবে। এনিয়ে নারীদের মধ্যে ছিল এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা। নারীরা জীবনের অখ- অবসরকে এভাবেই কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু সেসব এখন অতীত। আজকাল নারীদের হাতে শোভা পায় না উল কাঁটা। তারা ব্যস্ত আধুনিক নানা কাজে। ফলে এক সময়কার গর্বিত সূক্ষ্ম কারুকাজের শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। কি গ্রাম, কি শহর! সর্বত্র ছিল উল কাঁটার ব্যবহার। একটা সময়ে স্কুল-কলেজের নারী শিক্ষকরা পরিচিতই ছিল উল কাঁটার শিল্পী হিসেবে। কোথাও কোথাও বলা হতো ‘উল বুনিয়ে’ কিংবা ‘সোয়েটার কারিগর’। ক্লাসের ফাঁকে অবসর সময়টা তারা পার করেছে পশমি উল কাঁটায় নানা পোশাক তৈরি করে। কখনো কখনো এ নিয়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। হয়তো স্কুল পরিদর্শক এসেছে। কিংবা শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। কেউ কেউ দল বেঁধে চলে গেছে পাশের বাড়ির ফলমূলের ক্ষেতে। নারী শিক্ষিকা মগ্ন উল কাঁটার বিনুনিতে। এমনকি কোলের শিশুটিও নেমে পড়েছে মাটিতে। তাতেও ভ্রƒক্ষেপ নেই। দক্ষিণের গ্রামাঞ্চলে নৌপথে লঞ্চ কিংবা নৌকায় দীর্ঘ যাত্রার অবসরেও বহু নারীর সঙ্গী ছিল উল কাঁটা। নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে নারীরা আপন মনে গেঁথেছে লাইনের পর লাইন। আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়েও মিলত অবসর। প্রায় প্রতিটি গ্রাম কিংবা মফস্বল শহরে বহু নারী ছিল, যারা উল কাঁটা বুনিয়ে হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিল। এক নামে ছিল পরিচিতি। শীত আসার আগেই গাঁ-গেরাম কিংবা মফস্বল শহরের নারীরা দল বেঁধে গ-ি ভেঙে নেমে পড়ত পশমি উল জোগাড়ে। পশমি উল মিলত অনেক জায়গায়। ক্ষুদ্র মুদি- মনোহারি দোকানে পাওয়া যেত নানা রঙের উল। কাপড়ের দোকানেও বিক্রি হয়েছে। কম দাম-বেশি দাম, দেশী-বিদেশী। ছিল নানা ভ্যারাইটি। বিদেশ থেকে পুরনো কাপড়ের বস্তাতে মিলত উলের নানা ধরণের পোশাক। পুরনো সেসব পোশাক থেকে জোগার হতো উল। অক্ষত রঙিন পোশাকের দাম যাই হোক, তা নিয়ে টানাটানি লেগে গেছে। পুরনো গাউন বিক্রেতাদের সঙ্গে উল বুনিয়ে নারীদের এক ধরণের সখ্য গড়ে উঠত। নতুন বস্তা এলে খবর পৌঁছে যেত নারীদের কাছে। মা-বোনদের জন্য যেসব গাউনের পোশাক পুরুষরাও কিনে নিয়ে যেত। উল দিয়ে কী না বোনা হতো! সোয়েটার-জাম্পার তো ছিলই। বাড়ির বয়স্কদের জন্য বোনা হতো কানটুপি ও পায়ের মোজা। শিশুদের জন্যও তা বোনা হতো। গলার মাফলার, গায়ের চাদর, লম্বা হাতের ব্লাউজ, শীতে সবই বোনা হতো। বিয়ের আগে পছন্দের পুরুষের জন্য মেয়েরা গোপনে জাম্পার কিংবা সোয়েটার বুনে দিত। আর তা নিয়ে পুরুষ মহলে সে কি উত্তেজনা। কে কাকে বানিয়ে দিয়েছে, এ নিয়ে হতো গুঞ্জন। ডিজাইন ও বুননের স্টাইল নিয়ে নারীমহলে হতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কে কাকে নতুন ডিজাইন দিয়ে টেক্কা দিতে পারে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি হতো নানামুখী কানাকানি। নারীদের উল কাঁটার সূক্ষ্ম কারুকাজের এ দিকটি এখন প্রায় বিলুপ্ত বলা যেতে পারে। বিশেষ করে গত শতকের আশির দশক থেকে হাতে বোনা উলের পোশাক কদর হারাতে থাকে। গার্মেন্টস খাতের ব্যাপক প্রসার এ সময় ঘটে। ওই সময়ে পশমি উলের পোশাক বোনার জন্য এক ধরনের মেশিনও বাজারে আসে। আর এখন তো হাতের কাছে কম দামে মিলছে দেশী-বিদেশী মেশিনে বোনা সোয়েটারসহ শীতের নানা পোশাক। নজরকাড়া বাহারি রঙের পোশাকে এখন বাজার সয়লাব। নারীরাও এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের এখন সময় কাটছে টিভির পর্দার রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপে, না হয় আধুনিক প্রযুক্তি ঘেটে কিংবা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার নিয়ে। নারীদের এখন সময় নেই দম ফেলার। প্রিয় মানুষের গায়ে মমতা মাখা হাতে বোনা সোয়েটার তুলে দেয়ার নির্মল আনন্দ থেকে নারীরা এখন বঞ্চিত। আধুনিক জীবনযাপন নারীদের নিয়ে গেছে অন্য জগতে। এ নিয়ে নেই কোন মনবেদনা। Ñশংকর লাল দাশ গলাচিপা থেকে
×