ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর হাতে উল-কাঁটা

হারানো দিনের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

হারানো দিনের কথা

কাঁটায় উল সুতায় সোয়েটার, হাতমোজা, মাফলার, শিশুদের মাথার টুপি, মেয়েদের কার্ডিগান বোনার দিন ফুরিয়েছে। এখন আর কোন নারীকে দুই হাতে দুটি এক ফুট বা দেড় ফুট লম্বা প্লাস্টিক কিংবা স্টিলের কাঁটায় উল সুতায় সোয়েটার অথবা শীতের পোশাক বানাবার দৃশ্য চোখে পড়ে না। নিকট অতীতে প্রায় প্রতিটি ঘরে উল সুতায় সোয়েটার বোনার চল ছিল। নারীর পাশাপাশি অনেক পুরুষ কাঁটায় উল সুতায় সোয়েটার বুনতে পারত। কাঁটার বদলে সাইকেলের স্পোককে কাঁটা বানিয়েও উল বুনানো হয়েছে। কাঁটায় সোয়েটার বুনানোও ছিল আর্ট। সকলকে দিয়ে তা সম্ভব হতো না। কাজটি একই সঙ্গে ধৈর্যের ও অঙ্কের ফর্মুলা মনে রাখার মতো। ডিজাইনের সূত্রগুলো মনে না রাখলে আসল ডিজাইনের সোয়েটার বুনানো সম্ভব ছিল না। কাঁটায় হাতে সোয়েটার বোনার অনেক রকমের ডিজাইন আছে। সবচেয়ে কঠিন ডিজাইনের নাম ‘হানিকম প্যাটার্ন’। অর্থাৎ সোয়েটারটির নক্সা দেখতে হবে মৌচাকের মতো। প্রজাপতি, টিয়া পাখি, নৌকা, যে কোন দৃশ্য সবই উলের সোয়েটারে আঁকা যায়। ডিজাইনের ফর্মুলাগুলো এ ধরণের- ডান দিকের কাঁটার দুই সুতা ছেড়ে বাম দিকের কাঁটার তিন ঘর। ডান দিকের কাঁটার একঘর বন্ধ রেখে বাম দিকের একঘর ডাবল করা। এই ধরণের নানা হিসাবের ফর্মুলা লিখে রাখা হতো। মুখস্থ করার পর বোনার সময়ে দুই একবার ভুল হওয়ার পর ঠিক করে নেয়া যেত। এক্সপার্টদের হাত এত দ্রুত চলত যে ৩/৪ দিনের মধ্যে বড়দের সোয়েটার বোনা যেত। যারা দিনমান কাজের ফাঁকে সোয়েটার বুনেছে, তাদের অনেকটা সময় লাগত। কখনও কয়েকজন সারিবদ্ধ হয়ে বসে উল সুতা ছড়িয়ে দিয়ে বোনার কাজ করত। সোয়েটারকে আকর্ষণীয় করার জন্য কখনও কয়েক রঙের উলের মিশ্রণে বোনা হতো। কোন কারণে হাতে সোয়েটার বানানোর শেষের দিকে ভুল হয়ে গেলে মাথায় হাত। সব খুলে ফের নতুন করে বুনতে হতো। সোয়েটার, কার্ডিগান, মাফলার, হাতমোজা, শিশুদের টুপি, মেয়েদের চাদরসহ সব বোনা হতো কাঁটায়। কত ঘনত্বের সোয়েটার বানানো হবে, তার ওপর নির্ভর করত উল ও কাঁটার নম্বর। উলের ও কাঁটার নম্বর ছিল। কোন কাঁটা মোটা কোন কাঁটা চিকন কোন উল সুতার ঘনত্ব বেশি কোনটির কম। চিত্র শিল্পীরা যেমন বিভিন্ন নম্বরের তুলি ব্যবহার করে, উল শিল্পীরা তেমনই সেলাই অনুযায়ী বিভিন্ন নম্বরের কাঁটা ও উল ব্যবহার করেছে। হাতে বোনা সোয়েটার বানানোর ধারা কমতে শুরু করে গত শতকের আশির দশকে। তখন সোয়েটার কার্ডিগান বাননোর ম্যানুয়াল যন্ত্র দেশে আসে। উল লুম নামের এই যন্ত্র শহরের মহিলা ক্লাব, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে কিনে নারীদের এই মেশিনে সোয়েটার বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে হাতে বোনা সোয়েটার পরিধান করে যেমন নরম পশম উষ্ণতার পরশ পাওয়া যায়, যন্ত্রে বোনা সোয়েটারে তেমন মেলে না। তারপরও দ্রুত তৈরির জন্য এই যন্ত্রে সোয়েটার বোনা শুরু হয়। হাতে বোনা সোয়েটারে যেমন অনেক ফর্মুলায় কয়েক ধরণের নক্সা করা যায়, যন্ত্রে তা হয় না। যন্ত্রের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ডিজাইন দেয়া থাকে। যন্ত্রে তাঁতের মতো সোয়েটার বোনার সময় উল সুতার পশম অংশের কিছু কেটে পড়ে। ফলে সোয়েটারের ঘনত্ব কমে যায়। বর্তমানে হাতে বোনা ও ম্যানুয়াল যন্ত্রে সোয়েটার কার্ডিগান তৈরির দিনও শেষ হয়ে সোয়েটার ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এসব ফ্যাক্টরি থেকে সোয়েটার কার্ডিগানসহ শীতে উলের পোশাক তৈরি হচ্ছে। বিদেশ থেকেও আমদানি হয়ে আসছে সোয়েটারসহ নানা ডিজাইনের উলের বস্ত্র। বর্তমানে চীন হংকং থাইল্যান্ডের তৈরি নানা ডিজাইনের সোয়েটার কার্ডিগান শিশুদের উল বস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। হকার্স মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে উলের তৈরি বস্ত্র। হকার্স মার্কেটে দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। এক/দেড়শ’ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় সোয়েটার। হকার্স মার্কেটে উলের তৈরি এমন কোন পণ্য নেই, যা মেলে না। পুরাতন উলও পাওয়া যায় হকার্স মার্কেটে। বগুড়ার হকার্স মার্কেট থেকে এসব পুরাতন উল কিনে নিয়ে যায় আদমদীঘির শাইওল গ্রামের কম্বলের কারিগররা। ওই গ্রামের প্রতিটি ঘরে উল লুমে কম্বল তৈরি হওয়ায় গ্রামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কম্বলের গ্রাম নামে। বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা জানান, শীতের আগে উল সুতায় সোয়েটারসহ নানা ধরণের শীত বস্ত্র বোনা হতো। নবজাতকের জন্য উলের টুপি বানানো ছিল রেওয়াজ। শীত মৌসুমে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানী দাদিরা উল-কাঁটা নিয়ে নবজাতকের জন্য শীতবস্ত্র বোনা শুরু করতেন। ষাটের দশকে জনপ্রিয় কিছু উল সুতা ছিল। যেমন এবিসি, ওকে, সানসাইন ইত্যাদি। জনপ্রিয় উল সুতার কদর ছিল। এর মধ্যে মজারও বিষয় ছিল, যে উল সুতায় পশমের মাত্রা বেশি এবং গায়ে চরালে চিটমিট করে, সেই সুতা এড়িয়ে চলত অনেকে। তবে এমন উল সুতায় বুনানো সোয়েটারে উষ্ণতা বেশি হতো। সেদিনের উলের বুনানো সোয়েটার আজ জাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আজ যারা মধ্য বয়সী এবং প্রবীণ তাদের ঘরে হাতে বুনানো সোয়েটার থাকতেও পারে। হয়ত আছেও। যাদের আছে তারা তা সযতনে রেখে দিয়েছে। যার হাতে বোনা, সোয়েটারে তার হাতের মমতার স্পর্শ রয়েছে। হারিয়েই বুঝি গেল সেই হাতে বোনা সোয়েটার, কার্ডিগান, হাতমোজা, শিশুদের টুপি, মাফলার।
×