ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহিলা পরিষদের জাতীয় পরিষদ সভা শুরু

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে নারী সমাজকে জ্বলে ওঠার তাগিদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে নারী সমাজকে জ্বলে ওঠার তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমরা নারী শ্রমিকরা গার্মেন্টসের চাকা ঘুরাই। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি কিন্তু আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের কোন মাতৃত্বকালীন ছুিট নেই, আমরা আমাদের প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছি না, মালিকরা আমাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও অধিকার দিচ্ছে না। অন্যদিকে মালিকরা লাভবান হচ্ছেন। ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু নারী শ্রমিকরা আজও স্বাধীনতা পায়নি। আমরা যে উপার্জন করি তা দিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের ভালভাবে লালন পালন করতে পারি না। তাই আমাদের দাবি নিম্নতম বেসিক মজুরি দিতে হবে ১০,০০০ টাকা। ১০০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও ১০০০ টাকা যাতায়াত ভাড়া দিতে হবে। কথাগুলো বলছিলেন নারী শ্রমিক শিরিন আক্তার। ‘সকল শ্রেণী পেশার নারীদের যুক্ত করি, অন্তর্ভূক্তিমূলক নারী আন্দোলন গড়ে তুলি’ সেøাগানের মধ্য দিয়ে তোপখানা রোড সংলগ্ন বিএমএ মিলনায়তনে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত দু’দিনের জাতীয় পরিষদ সভা। শুক্রবার সকাল দশটায় সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানমের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু উপস্থিত সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘জাতীয় পরিষদ সভা একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সভা। ২০১৬ সালে যেমন আমাদের অর্জন ছিল তেমন হতাশাও ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধিসহ হলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া জঙ্গীবাদের নৃশংস ঘটনা শক্ত হাতে দমন করেছে সরকার। এছাড়া বিভিন্ন আইন, নীতিমালা হয়েছে যা নারীর জন্য ইতিবাচক। কিন্তু সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়নি। যেমন, সিডওর ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার না করা, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ও জেন্ডার বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসর হয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমগ্র নারী সমাজকে কাজ করতে হবে।’ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নরসিংদীর বেলাব উপ-জেলার কৃষক নারী প্রতিনিধি রানু আরা বেগম বলেন, ‘নারী কৃষকেরা ফসল মাড়াই থেকে শুরু করে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের কাজ করার পাশাপাশি গৃহের কাজও করে। রাষ্ট্রের উন্নয়নে আমরা ভূমিকা রাখি কিন্তু আমাদের কাজের মূল্যায়ন হয় না। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি কৃষক হিসেবে নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে, সরকারীভাবে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে, নারীবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা করতে হবে, নারী কৃষকদের আলাদা তালিকা করতে হবে, প্রযুক্তি বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে, নারীর কৃষকের অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে, মজুরি বৈষম্য দূর করতে হবে। সব শেষে মহিলা পরিষদের পাশে থেকে নারী কৃষকদের দাবি বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করেন তিনি। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী সুরাইয়া সাবরিনা আশা। তিনি বলেন, ‘নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। এখানে পিতৃতন্ত্র সবচেয়ে বড় বাধা। পরিবারের সুশিক্ষার অভাবে তরুণরা আজ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এর ফলে নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ ধরন হচ্ছে পর্ণোগ্রাফি, যা নারীদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে। কাজেই নারী নির্যাতন প্রতিহত করতে তরুণ প্রজন্মকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং নারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘২০১৬ সাল ছিল আশা-নিরাশা, সম্ভাবনা-সঙ্কট, ইতিবাচক-নেতিবাচক একটি বছর। দেশ-বিদেশী চাপ থাকা সত্ত্বেও সরকার শক্ত হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। মানবতার বিরুদ্ধে যত আন্দোলন হবে তার সঙ্গে নারী আন্দোলন থাকবে, থাকবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একনায়কতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যাচ্ছে। তাই আমরা বিশ্বাস করি এখনই সময় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মহিলা পরিষদকে জ্বলে উঠতে হবে।’ এসময় তিনি পাঠ্যসূচী বিষয়ে বলেন, ‘যে শিক্ষানীতি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলো সেখান থেকে কিভাবে অদৃশ্যভাবে পাঠ্যসূচীতে সাম্প্রদায়িকতা এবং লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হলো তা সত্যিই দুঃখের বিষয়। হিন্দু, মুসলিম, দলিত, হরিজন সকলেই এদেশের নাগরিক। তিনি বলেন নারী আন্দোলন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমর্থন করে। ১৯৭০ সালে থেকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী আন্দোলন যে লক্ষ্যে এই সংগঠনের জন্ম হয়েছিল আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কি এই পাঠ্যসূচী থেকে সেভাবে তৈরি হবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি। সভার প্রথম কর্ম অধিবেশনে আরও উপস্থিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিজলী রেজা, সহ-সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনিরা বেগম অনু, সহ-সভাপতি ডাঃ মাখদুমা নার্গিস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, মডারেটর সহ-সভাপতি সৈয়দা শামসে আরা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্ত, মডারেটর সহ-সভাপতি ডাঃ ফওজিয়া মোসলেম প্রমুখ। অধিবশেন সঞ্চালনা করেন প্রশিক্ষণ, পাঠাগার ও গবেষণা সম্পাদক রীনা আহমদ।
×