ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নীলসাগরে পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য

সারাক্ষণ কিচির-মিচির কলরব, যেন পাখির কনসার্ট

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

সারাক্ষণ কিচির-মিচির কলরব, যেন পাখির কনসার্ট

তাহমিন হক ববী ॥ সারাক্ষণ কিচিরমিচির, কলরব। যেন পরিযায়ী পাখিদের সমবেত কনসার্ট চলছে। শীতের এই সময়ও মুখরিত নীলফামারীর নীলসাগর দিঘি। নানা রঙের, নানা আকারের পরিযায়ী পাখিরা মাতিয়ে রাখছে এলাকাটি। পাখিদের এই কনসার্ট শুনতে প্রতিদিন ভিড় করছে পাখিপ্রেমীরা। প্রচ- শীত থেকে একটু উষ্ণতার জন্য এসেছে তারা। সুদূর সাইবেরিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের আগমন। হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। পাখি শিকারীদের উৎপাত না থাকায় নীলসাগরে অত্যন্ত নিরাপদেই আছে। বহু শতাব্দী ধরে চলছে তাদের এই শীতকালীন ভ্রমণ। প্রতিবছরের মতো এবারও পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করেছে উত্তরের জেলা নীলফামারীর নয়নাভিরাম নীলসাগর দিঘিতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা নীলসাগরের চারপাশটা ঢেউ খেলানো সবুজে ঘেরা। দেখে যে কারও মনে হবে, সবুজ শাড়িতে সুসজ্জিত সলজ্জ বধূ। নীলসাগরের পরিবেশ যেকোন প্রকৃতিপ্রেমীর উদাস মন নিমেষেই অজানা-অপ্রত্যাশিত প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারে। নীলসাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নারকেল, বনবাবলা, আকাশমণি, মেহগনিসহ অজানা-অচেনা হরেক রকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি, যেন অনবরত প্রদান করছে গার্ড অব অনার। বিরাট রাজার কন্যা বিন্না। বিন্নার নামে সেই বিন্নাদিঘি, আবার কেউ বলেন বিরাট রাজার দিঘি। আর কালের আবর্তে আজকের নীলসাগর। এখন নীলসাগর দিঘিটি শীতের অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাখি দেখতে এখানে ছুটে আসছে বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মানুষ। বসেছে দর্শনার্থীদের মিলনমেলা। পাখিরা এখানে নির্বিঘেœ নেচে বেড়ায়, জলের ওপর নিজের ছায়া দেখে উল্লাসে গান গায়। নীলসাগরকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে জেলা প্রশাসন। বৃক্ষের সমারোহে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে পিকনিক স্পট। রয়েছে রেস্ট হাউস। ঘোড়ার গাড়িতে পুরো দিঘি পরিভ্রমণ করা যায়। তবে পরিযায়ী পাখিদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য দিঘি এলাকার চার পাশে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। সীমানা প্রাচীর দিয়ে নীলসাগরকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে শুধু অতিথি পাখিদের জন্য। সারাদেশে বনবিভাগের চিহ্নিত পাখির কলোনি রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে শুধু উত্তরাঞ্চলেই রয়েছে ৫১টি। পাখির প্রতি উত্তরাঞ্চলের মানুষের বিশেষ ভালবাসা এবং পাখি রক্ষায় সামাজিক সচেতনতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। নিরাপত্তার কারণেই পরিযায়ী পাখিরা উত্তরাঞ্চলকে বেছে নিয়েছে। ফলে প্রতিবছরই বাড়ছে পাখির সংখ্যা। উত্তরাঞ্চলের ৫১টি পাখি কলোনির মধ্যে গাইবান্ধায় দুটি, বগুড়ায় তিনটি, রাজশাহীতে ১১টি, দিনাজপুরে একটি, সিরাজগঞ্জে একটি, নওগাঁয় ১৩টি, পঞ্চগড়ে দুটি, নাটোরে চারটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি, পাবনায় তিনটি, ঠাকুরগাঁওয়ে একটি, জয়পুরহাটে সাতটি, রংপুরে একটি, নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জে একটি। উত্তরের কিছু স্বেচ্ছাব্রতী মানুষ তাদের ঝোপঝাড়, গাছপালা ছেড়ে দিয়েছেন পাখির জন্য। নীলফামারীর সৈয়দপুর ও দিনাজপুরের খানসামায় ‘সেতুবন্ধন’ নামে একটি সংগঠন নিঃস্বার্থভাবে পাখি রক্ষায় কাজ করছে। অনেক মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেউ যেন পাখি শিকার না করেন, বাচ্চা ধরে না নেন, এসব দেখভাল করছেন। এ কারণেই দেশের অন্য সব এলাকার তুলনায় উত্তরে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। সেতুবন্ধনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, পাখিদের আবাস গড়ে তুলতে গাছে গাছে মাটির পাতিল বেঁধে দেয়া হয়েছে। শিকারীদের হাত থেকে পাখি রক্ষায় মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এদিকে নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলা বাজার সংলগ্ন বিশাল বটগাছে কলোনি বানিয়ে বসবাস করছে হাজারো শামুকখোল পাখি। সেখানেই বাচ্চা দেয় তারা। এলাকাবাসী সকলে মিলে শামুকখোল পাখিদের সুরক্ষায় রেখেছে। পাখিরাও স্বজন ভেবে নেমে আসছে নিচে এবং স্বাধীন চেতনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিক। নীলফামারী জেলা শহর হতে মাত্র ১৫ কিমি দূরে নীলসাগর। প্রায় দুই কিমি এলাকাজুড়ে ৫৫ একর জমির ওপর এই বিরাট দিঘি। লোকমুখে প্রচলন, অষ্টম শতাব্দীর বিরাট রাজার গো-খামার ছিল এখানে। শত শত গরুর পানি খাওয়ানোর জন্য বিরাট রাজা এই দিঘি খনন করেছিলেন। আর রাজার মেয়ে বিন্নাবতীর নামে দিঘির নামকরণ করা হয় বিন্নাদিঘি। বিন্না থেকে এটি বিরাট দিঘি। আর গো-খামার থেকে এলাকাটির ইউনিয়নের নাম হয়ে যায় গোড়গ্রাম। ১৯৮৩ সালে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নীলসাগর।
×