ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ায় শক্ত অবস্থানে গার্মেন্টস খাত

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ায় শক্ত অবস্থানে গার্মেন্টস খাত

এম শাহজাহান ॥ গার্মেন্টস খাতের ওপর থেকে কালো মেঘ কেটে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। এবার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে জিএসপি পুনর্বহালে ওবামা প্রশাসনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ করবে সরকার। আগামী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার টিকফা ফোরামের বৈঠকের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। ওই বৈঠকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য জোরালো দাবি রাখবে বাংলাদেশ। প্রতিযোগী ভিয়েতনাম নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল তা দূর হয়ে নতুন বিনিয়োগের কথা ভাবছেন পোশাক রফতানিকারকরা। আশা করা হচ্ছে, এসব উদ্যোগের ফলে আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হবে গার্মেন্টস খাত। জানা গেছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ইস্যুতে গত চার বছর আগে মার্কিন সরকার বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের ওপর বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে চাপের মুখে পড়ে পোশাক খাত। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রম অধিকার সম্পর্কিত ১৬ শর্তসংবলিত বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় দেশটির বাণিজ্যবিষয়ক দফতর ইউএসটিআর। শুধু তাই নয়, নতুন করে মার্কিন প্রশাসন টিপিপি চুক্তি করে। এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। ভিয়েতনাম হয়ে ওঠে নতুন আতঙ্ক। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উদ্যোগে সবগুলো শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। কিন্তু এরপরও ওবামা প্রশাসন রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করেনি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মানুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এটি ন্যায্য অধিকার। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই টিপিপি চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের কাছে জিএসপি সুবিধা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের পরিচালক নেসার উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ট্রাম্প আসার পর টিপিপি চুক্তি বাতিল করায় পোশাক রফতানি নিয়ে সব ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হয়েছে। প্রতিযোগী ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, সব শর্ত পূরণের পরও রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা নেই। তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইতিবাচক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এগিয়ে নেবে বলে আশা করছি। আর এ কারণে নতুন করে জিএসপি সুবিধা চাওয়া হবে। তিনি বলেন, এপ্রিলের টিকফা ফোরামের বৈঠকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেই জোরালো দাবি করা হবে। এদিকে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী চার বছরের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পোশাক খাতের রফতানি হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাকি ১০ বিলিয়ন ডলার আসবে চামড়া, ওষুধ, জাহাজ, আইসিটি, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক এবং এ্যাগ্রো প্রোডাক্টস ও প্রসেসড পণ্য রফতানি করে। এ লক্ষ্যে পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হবে। উৎপাদনে নৈপুণ্যের উন্নয়ন, চীন ও ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাজার সম্প্রসারণে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) এবং পিটিএ’র মাধ্যমে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হবে। এতে বহিঃবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া রফতানি শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, রফতানি পণ্যের গুণগতমান ও প্রতিযোগী মূল্য নিশ্চিত করা হবে। সম্ভাবনাময় তথ্যপ্রযুক্তিভিক্তিক পণ্য ও সেবা রফতানির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, প্রাধিকার নির্ধারণ, রফতানি সম্প্রসারণে বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ, বাণিজ্যিক উইংসমূহের কার্যক্রমকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, রূপকল্প-২১ বা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ঘোষণা বাস্তবায়নযোগ্য কি-না সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও উদ্যোক্তারা বলছেন, আগামী চার বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি সম্ভব। এজন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির তাগিদ দেয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের আওতায় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। রফতানি বাণিজ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে শুধু পোশাক শিল্পে আরও ২৯ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে এ শিল্পে ৪০ লাখ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এছাড়া পোশাক শিল্পে এখন প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ২০ বছর নাগাদ এ শিল্পের গ্রোথ এ হারেই বাড়বে। এ গ্রোথ ধরে রাখার জন্য গার্মেন্টসপল্লী স্থাপনসহ অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি জনকণ্ঠকে বলেন, রূপকল্প-২১ অনুযায়ী আগামী চার বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করা সম্ভব। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতি বছর গড়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। এ প্রবৃদ্ধি এখন হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে অবশ্যই পোশাক রফতানি বাড়ানোসহ জিএসপি পুনর্বহালে জোর লবিং চালাতে হবে। সরকার টু সরকার (জিটুজি) এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এছাড়া বিজিএমইএ থেকেও জিএসপি পুনর্বহালে ব্যবসায়ী টু ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, দেশের পোশাক খাতে সহযোগিতা দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, নতুন সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের বাজার আরও বড় হবে। তৈরি পোশাকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে ট্রাম প্রশাসন এগিয়ে আসবে বলে মনে করছি। জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে নয়া মার্কিন প্রশাসনের কাছে পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা চাওয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেল শীঘ্রই এ ব্যাপারে ইউএসটিআরে চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পোশাকে জিএসপি সুবিধা পাওয়া গেলে অতিরিক্ত আরও ৬ হাজার কোটি টাকার রফতানি আয় বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যুক্তরাষ্ট্র ৪ হাজার ৮৮০টি পণ্যে ১২৯ দেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৫০ রফতানিকারক দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়া রফতানিতে বাংলাদেশের ৯৭ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টস, টেক্সটাইল এবং নিটওয়্যার পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি। ফলে ৯৭ পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেয়া হলেও তার অধিকাংশ পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় না। অথচ গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও নিটওয়্যার- এ তিনটি পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া গেলে দেশের রফতানি আয় আরও বাড়ানো যেত। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা স্টাডি করে দেখছি পোশাক রফতানিতে শুল্ক সুবিধা পাওয়া গেলে রফতানি আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
×