ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা ফারুক

শুভ জন্মদিন ॥ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

শুভ জন্মদিন ॥ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কবিতার কালপরিক্রমায় উজ্জীবিত কাব্যধারা বাংলা কাব্যজগতকে যেমন করেছে হৃদ্য, একইভাবে স্বাধীনতার উত্তাল প্রকৃতিতে বিসিক্ত কবিরাও হয়ে উঠেছেন সৃষ্টি ও সৃজনশীল কাব্য স্রষ্টার অমিয় প্রতিকৃতি। দশক বিশ্লেষণে সত্তরের কবি ও কবিতা তাই এক নিজস্ব সড়ক ধরে যেতে যেতে রচনা করেছে এমন এক হৃদয়জ কাব্যভুবন যার অন্তর্নিহিত কনসেপ্টকে অন্য এক মাত্রায় অভিষিক্ত করেছে স্বমহিমায়। সত্তরের কবি ও কবিতা যেন বৈপ্লবিক আত্মানুসন্ধানের এক একটি প্রতিচ্ছবির ক্যানভাসে আঁকা অয়েল পেইন্ট। তীব্র রঙের ফিউশনে জ্বলজ্বলে আর সকরুণ মূর্ছনায় বেজে ওঠা বিমূর্ত কনেটের মায়াবী সিম্ফনি যেন। আর ওই লিরিক্যাল সিম্ফনির রিদমে যে কবির নামটি থেমে থেমে বেজে ওঠে ম্যাজিক অর্কেস্ট্রায় তিনি কবি কামাল চৌধুরী। প্রথাগত সত্তরের দশকের অবিশ্রাম কবিতার রচয়িতা কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার অবয়বে যে আলোকচ্ছটা প্রক্ষেপিত হয়েছে গত দীর্ঘ সময় ধরে ওই আলোর ফোয়ারা বাংলা কবিতার উদ্যানে আজ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পেয়ে গেছে এক নিজস্ব হাইওয়ে। যে হাইওয়েতে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার ফিটন গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে অনশ্বর জ্যোৎস্নাপুঞ্জের কণাগুচ্ছ ছড়াতে ছড়াতে। তার শুরুটা মধ্য সত্তরের হলেও তার কবিতা যেমন বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাসকে ধারণ করে স্বকীয় আদলে উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি সমকালীন তথা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার সুতীব্র আকাক্সক্ষার পঙ্ক্তিও গুঞ্জরিত হয়েছে অনন্ত বিপ্লবের চেতনাকে বুকে লালন করে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম, মিছিল, সমাবেশ, বঙ্গবন্ধু, ১৫ আগস্টসহ নানা ছবির কোলাজে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে নৈসর্গিকরূপেই। পাশাপাশি তার কবিতার মর্মরে জেগে ওঠে গ্রাম-বাংলার সেই চিরচেনা প্রকৃতি, বাঙালী সংস্কৃতির আবহমানতার প্রতিকৃতি- নদী, নৌকো, চর, কাশবন, গ্রাম্যবধূ, কিশোর-কিশোরী, ভাটিয়ালি, বনভূমি আর মানবিক হৃদয়জ প্রেমের পঙ্ক্তিগুচ্ছ। একজন পরিণত আর পরিমার্জিত কবিতার স্রষ্টা কামাল চৌধুরীর কবিতা মানেই অন্য এক আবেগমথিত ধু-ধু প্রান্তর। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে নিঃসঙ্গ ঝাউবনের চূড়োয় বসে দোল খাওয়া বিষণœ সি-গালের ফেব্রিকের মতো নরম পালকে নির্জন গোধূলির অস্তগামী ছায়া। আর ওই ছায়ার ছায়াচ্ছন্ন মনের অদূরে ভেসে যাওয়া সমুদ্রের উত্তাল জলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের গহন নিঃসঙ্গ ফোটা সান্ধ্য প্রহর। মনোহর মেঘ আর বৃষ্টির কোমল ভোরের গল্পগাথার মতো কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার মাঠজুড়ে ধুম বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ছুটন্ত ট্রেনের শার্সি কাঁচের যে চিত্রবীথি উঠে ফুটে, তাতেও এক অন্তহীন চিত্রকল্প আর উৎপ্রেক্ষিত রডোডেন্ডন ছড়িয়ে দেয় ডিওডরেন্টের মধুর নির্যাস। কখনোবা কুয়াশায় ডুবে থাকা ফরেস্ট হিলের চূড়ায় ঘুমন্ত ডাকবাংলোর জানলার মখমলি পর্দার ভাঁজে ভাঁজে স্নো-হোয়াইট ভোরের রৌদ্রপুঞ্জের মতো কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার শব্দ, পঙ্ক্তির গুঞ্জন যায় বেজে হিম হাওয়ার হু হু ভায়োলিনে। নাগরিক মন নিয়ে আটপৌরে কবিতা যেমন তিনি রচনা করে চলেছেন ন্যাচারাল প্যাটার্নে, তেমনি নগরজীবন আর আন্তর্জাতিকতার প্রকৃত চিত্রটাও তার কবিতার পলেস্তারা, মিডর‌্যালে পাখির মিহিন সুরের মতোন বিস্তার করেছে রোঁয়া ঝরা রেশমি কলস্বর। তার কবিতায় শৈশব, কৈশোরের ছবি যেমন চিত্রিত হয়েছে নিবিড় মুগ্ধতায়, যৌবনের ছবিও চিত্রিত হয়েছে আরও সুনিপুণ, আরও নিখুঁত ঐশ্বর্যময়তা নিয়ে। আর সেই উজ্জ্বল সময়টাই উঠে এসেছে তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’তে। এবং তার প্রথম এ কাব্যগ্রন্থ সময়ের এক ঐতিহাসিক দস্তাবেজ হিসেবে আজও আধুনিক বাংলা কবিতার দরকারি প্রেক্ষাপটে পরিগণিত হয়েছে। এরপর একে একে প্রকাশিত তার বিশের অধিক কাব্যগ্রন্থে তিনি নিজের অবস্থান, মনের গতিপ্রকৃতি, সমকাল, ভালবাসা, বঞ্চনা, মনোজাগতিক আত্মোপলব্ধি, প্রকৃতি, নাগরিকবোধ, বৃক্ষ, পাখি, রাজপথের তুখোড় আন্দোলন আর জীবনের প্রতিটি স্পন্দনের পরতে পরতে কখনো রিয়েলিজম, কখনোবা সুররিয়েলিজমের ব্রাশে তার কবিতার করৌঞ্চ ফুলের মতো মুখাবয়বকে এঁকেছেন গভীর দক্ষতায়। তার কবিতা বিগত সময়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্ট্রিট ছুঁয়ে আজ এসে দাঁড়িয়েছে এক পরিশীলিত কাব্য জংশনে। আধুনিকতার রেলিঙ্গে দাঁড়িয়ে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা যেমন স্পর্শ করেছে উত্তর আধুনিকতার ক্রিসেন্থিমাম, একইভাবে জাদু বাস্তবতার ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যান্ডিফোরার মায়াবী সুবাসে ভিজে উঠেছে তার কবিতার মন। একজন কবি কামাল চৌধুরী কবিতার নীল পুচ্ছজাগা লোকোমোটিভ যেমন এসে থেমেছে ধূসর তুষার ঝরা হিলস্টেশনে, তেমনি হু হু ঝাপসা কুজঝটিকায় ডুবে থাকা টার্মিনালেও ভিড়েছে তীক্ষè সাইরেন বাজিয়ে দূরের জাহাজের মতো। আর বনে বনে ঝরাপাতার কনসার্ট বাজে বিজন বিকেলে তুমুল হাওয়ায়। তার কবিতার পঙ্ক্তিজ্বলা জুঁই ফুল যেন ফোটে ওই বিকেলের প্রসন্ন পনিটেলে। এমনই এক ধারাবরিষণমুখর রেইনট্রির বাদলঝরা ছায়া জাগা কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠকের শুদ্ধ কাব্যবোধকে করে তুলেছে বিশুদ্ধ আর কাব্যপ্রেমী। পরিতৃপ্তি এক আপেক্ষিক শব্দ গাথা। বললাম এজন্য যে, কবি কামাল চৌধুরীর কাব্য অবস্থান সমকালীন আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গনে যে বিশালত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে অপেক্ষা এ রচনা খুবই নাতিপ্রস্থ এক চিলতে উঠোনের মতো। নিরবধি বহমান নদীর মতোই বিরামহীনভাবে লিখে চলেছেন তিনি। তার কাব্য রচনার অন-স্ক্রিন কখনোই ইন্টারভেলের ভেলভেটজ্বলা পর্দা নামিয়ে দিয়ে বলেনি- ‘চলো এই বেলা একরত্তি ঘুরে আসি’। ভালবাসি অন্য সবার মতো আমিও তার কবিতা এবং তাকে। ফাঁকে ফাঁকে কবিতার সেলফোন থেকে যে এসরাজের সুর ভেসে আসে- অনায়াসে ওই সুরের মায়াজাল কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার কাল হিসেবেই বিবেচিত হবে। আর তাই দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য পদকে ভূষিত কবি কামাল চৌধুরী কবিতার আউটার সিগন্যালে লাল অজস্র তারার পাঠক আছে জ্বলে-লক্ষ-কোটি তারাঙ্কিত ক্যানভাসে। কবির জন্মদিন আজ ২৮ জানুয়ারি। ৬০ বছরে উপনীত কবি দেশের এখন সিনিয়র সিটিজেন। জন্মদিনে কামনা তিনি দীর্ঘায়ু হোন এবং আরও সমৃদ্ধতর কবিতার স্রষ্টা হিসেবে চিরজাগরূক থাকুন। লেখক : কবি
×