ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পথশিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিলেন রেলকর্মী

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

পথশিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিলেন রেলকর্মী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ যেখানে মা নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন, স্বার্থের জন্য স্বামী, সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ গুম করছেন, একবিংশ শতকের এমন যুগে একটি অবুঝ পথশিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিলেন এক রেল কর্মচারী। মায়াভরা শিশুটির মুখটি মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে যাবে, তা হয়ত তিনি ভাবতে পারছিলেন না। তাই ঝাঁপিয়ে পড়ে রেললাইনের ওপর থেকে শিশুটিকে বাঁচালেন। কিন্তু নিজে বাঁচতে পারলেন না। দ্রুতগতির ট্রেন তার দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত নিথর শরীর পড়ে রইল রেললাইনের ওপর। যে রেললাইন আর ট্রেনের মেরামত কাজে নিজেকে দীর্ঘদিন নিয়েজিত রেখেছিলেন, সে ট্রেনই তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল। সাহসিকতার চরম মূল্য দিলেন তিনি। সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে সবার মনে জায়গা করে নিলেন সত্য, কিন্তু নিজের জায়গা হলো পরপারে। পরিবার-পরিজনকে কাঁদিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন এই রেল কর্মচারী। অবুঝ পথশিশুর জন্য এমন মায়ার শরীর যার, সে মানুষটিকে দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করেছিলেন ঘটনাস্থল কুড়িল বিশ্বরোডে। রেল কর্তৃপক্ষ এমন সাহসী ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করতে নিহতের পরিবারকে আশ্বাস দিয়েছে। শুক্রবার দুপুর একটা। রেল কর্মচারী বাদল মিয়া (৫৮)। তিনি রেললাইন ও ট্রেনের মেকানিক ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের ৭৬ নম্বর গ্যাংয়ে। একদিকে ছুটির দিন, আরেকদিকে পবিত্র শুক্রবার। কাজের ফাঁকে জুমার নামাজ আদায় করতে কুড়িল বিশ্বরোডের দিকে থাকা কাছের একটি মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে থানার এসআই আলী আকবর জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার সময় রেললাইন পার হচ্ছিল একটি শিশু। শিশুটির বয়স পাঁচ-ছয় বছর হবে। এ সময় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুরমা এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাচ্ছিল। রেললাইনের ওপরের শিশুটিকে রেল কর্মচারী বাদল মিয়া বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোনমতে শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে রেললাইনের বাইরে পার করে দিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিজে পার হতে পারেননি। এ সময় ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাদল মিয়ার শরীর। গগনবিদারী আর্তনাদের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাদল মিয়ার প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়। রক্তাক্ত নিথর শরীর পড়ে থাকে রেললাইনের ওপর। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। মুহূর্তেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও রেল বিভাগের পুলিশ এবং রেল কর্তৃপক্ষের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ততক্ষণে সেখানে শত শত মানুষের ভিড় লেগে যায়। সবার মুখে একই কথা। হায় এ যুগেও একজন পথশিশুর জন্য একজন মানুষ নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারেন! সত্যিই এখনও হৃদয়বান মানুষ আছে। উপস্থিত সবাই বাদল মিয়ার প্রশংসা করতে থাকেন। কিন্তু তার এমন সাহসিকতা দেখানো ঠিক হয়নি বলেও অনেকে মন্তব্য করেন। সবাই অঝোরে কাঁদছিল আর বাহবা দিচ্ছিল। সত্যিই বাদল মিয়াই সত্যিকারের মানুষ। এমন মানুষ ক’জন হতে পারে। অন্যের জীবন বাঁচাতে যে নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান নিহতের ছেলে মামুন মিয়া। তিনি খিলক্ষেত রেললাইনের অস্থায়ী গেটকিপার হিসেবে কর্মরত। পিতার এমন মৃত্যুতে নির্বাক মামুন। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে একাকার। বললেন, তার দাদার নাম মৃত হাতেম আলী। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মুখী গ্রামে। তারা পাঁচ ভাই তিন বোন। রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা আমাকে রেল বিভাগের চাকরিটি স্থায়ী করার পাশাপাশি আমার বড় ভাইকে রেল বিভাগে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আর কর্মরত অবস্থায় এভাবে মৃত্যুর কারণে রেল কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে নগদ অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন রেল বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারা। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের ওসি ইয়াছিন ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, নিহতের ময়নাতদন্তসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজ চলছে। সেই সঙ্গে তদন্ত চলছে। তবে যে শিশুটিকে বাদল মিয়া উদ্ধার করেছে, তাকে পাওয়া যায়নি। হয়ত ভয়ে শিশুটির মা শিশুটিকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
×