ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) ব্যাঘ্র শিকারনামা (ব্যর্থ প্রচেষ্টা) ঘাসের জঙ্গল ভেদ করে প্রথমে দৌড়ে আসলো এক আকর্ষণীয় নীলগাই। পশুটির মাথায় সবুজ ঘাস লেগে আছে, নাক দিয়ে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। নীলগাইটি হাতির পালের সামনে পড়েও এতটুকু ঘাবড়ালো না। সোজা শিকারীদের বরাবর ছুটে আসতে থাকলো। অনেক দূরে পেছনে এখন শোনা যাচ্ছে ঢাক-ঢোল আর অনেক মানুষের চিৎকারের হল্লা। নীলগাই মেরে বন্দুকের গুলি খরচ করতে আগ্রহী নন শাহজাদা সুজা। তিনি এসেছেন তাঁর পুত্রের জন্য বাঘ শিকার করতে। সুজা তাঁর প্রধান উজির বিসমিল্লাহ খাঁকে ইশারা দিয়ে বললেন, - এই জানোয়ারটা আপনার, এটা দিয়েই বিসমিল্লাহ করুন। অনুমতি পেয়ে বিসমিল্লাহ খাঁ তাঁর হাওদার উপর ভর দিয়ে বন্দুকের বাঁট চিবুকে ছোঁয়ালেন। ছুটন্ত নীলগাইটাকে মনে হচ্ছিল উদ্ধত, গর্বিত। এতোসব রাজকীয় শিকারীর তোয়াক্কা করে না। পশুটির দৌড়ের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারলেন না বিসমিল্লাহ। সশব্দে আওয়াজ তুলে গুলিটা লাগলো নীলগাইটির পেছনের পায়ে। দিক বদল করে আবার ঘাসের জঙ্গলে পালিয়ে যাবার আগেই তুঘরিল দ্রুত হাতে বন্দুক তুলে বরাবর মাথায় গুলি চালালেন। জায়গাতেই সেটা পড়ে গেল। -সাবাশ তুঘরিল! সুজা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন। বিসমিল্লাহ খাঁর দুইজন ভৃত্য দৌড়ে গিয়ে চাপাতি দিয়ে নীল গাইটির শ্বাসনালী কেটে দিলো। শূন্যে পা দাপিয়ে নিথর হয়ে গেল নীলগাইটি। দুই পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁবুতে। তুঘরিল জয়নুল আবেদীনকে উদ্দেশ করে বলতে থাকলেন, -ছোট হুজুর হুঁশিয়ার। এখন আপনার পালা। বাঘ দেখলেই ঠিক দুই চোখের মাঝখানে টিপ করবেন। ভুলেও পিঠে গুলি করতে যাবেন না। আপনার আব্বাজানের কথার বাইরে কিছু করবেন না। মনে রাখবেন শিকারে ভালো কিছু আশা করার পাশাপাশি সবচেয়ে খারাপটার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয়। লা হাওলা ...। শেষ কথাটা তুঘরিল তাঁর প্রথম বাঘ শিকারের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ পরই দলবেঁধে আরো নীলগাই, সম্বর, চিত্রা হরিণ, ষাঁড়, মোষ, এন্টিলোপ, বুনো শূকর ইত্যাদি নানা জাতের প্রাণী জংলা এলাকাটার দিকে তেড়ে এলো। দূরে তাড়িয়ে আনা দলটির চিৎকার আরো স্পষ্ট। হাতীগুলোর অস্থিরতা বেড়ে গেল আরো যখন পিঠের হাওদায় বসা শিকারীরা এক সঙ্গে পশুগুলো লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকলেন। আওয়াজে আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো পুরো এলাকা। পাখীর ঝাঁকগুলোও শিকারীদের নিশানার বাইরে যেতে পারলো না। মৃত-অর্ধমৃত পশু-পাখির চিৎকার আর কোলাহলে মনে হলো এই অরণ্যের অংশ যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। শিকলে বাঁধা হাতিগুলো শুঁড় উঁচু করে বৃংহতি নিনাদে যেন মানা করছে সেই অসহায় পশুগুলোকে মুঘল শিকারীদের বন্দুক আর তলোয়ারের সীমানায় না ঘেঁষতে। হঠাৎ ভীষণ রকমের গম্ভীর চাপা গর্জনে থমকে গেল সবাই। - জাঁহাপনা ... এটা সেই বাঘ। বিড়বিড় করে সুজাকে জানালেন তুঘরিল। - জয়নুল, তুমি প্রস্তুত তো? চাপা উত্তেজনায় সুজা ঘাড় ফেরালেন। জয়নুল রাইফেলের বাঁটে ঘাড় রেখে নিশানা করলেন। ঝোপের ভেতর হতে খুব ধীরে বেরিয়ে এলো পূর্ণবয়স্ক বিশাল বাঘটি। দেখতে রাজকীয় বললেও কম বলা হয়। সামনে ঘিরে আছে হাতীর পাল, পেছনে যাবার উপায় নেই। বাঘটি সামনে পালাবার পথ খুঁজতে থাকলো। বাঘের অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্র হাতীগুলোর উত্তেজনাও আরো বেড়ে গেল। সুজা’র পাশের হাতীটা টাল সামলাতে না পেরে ধাক্কা দিলো শাহজাদার হাতীকে। চিৎকার করে মাহুতকে হাতী সামলাতে বলার আগেই বাঘটি সরাসরি জয়নুল ও সুজার হাতীর মাঝ বরাবর জায়গা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবার জন্য দৌড় লাগালো। চোখ বড় করে গুলি চালালেন জয়নুল। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না। মুহূর্তে সুজার হাতির বিপজ্জনক দূরত্বে বাঘটি চলে এলো। দুইজন সৈনিক তলোয়ার হাতে বাঘটাকে ঠেকাতে যাওয়া মাত্র বাঘটি তার বিশাল থাবায় একজনকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে লাফ দিল সুজার হাতি বরাবর। সুজার মাহুত হাতী সামলাতে না পারায় সরাসরি গুলি চালাতে ব্যর্থ হলেন সুজা ও তুঘরিল। চারপাশে বিশাল শোরগোল উঠলো। অন্যেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুজার হাতিকে থাবা দিয়ে আঘাত করে দুই হাতির ফাঁক দিয়ে নিমিষেই পেছনের ঘন ঘাসের জঙ্গলে বাঘটা হারিয়ে গেল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন সুজা। বন্দুকের আঘাতে মাটিতে ফেলে দিলেন তাঁর মাহুতকে। আদেশ দিলেন তাঁর রক্ষীদের। - এই শুয়োরের বাচ্চার হাত-পা বেঁধে সামনে ঝুলিয়ে রাখ। আমার শিকারের বারোটা বাজিয়েছিস। তোকে আমি ছাড়বো না। - মাফ করে দিন মালিক। আমি ইচ্ছা করে করি নি। আমি মরে গেলে আমার পরিবারের দেখাশোনা করার কেউ নাই হুজুর। ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো নাম না জানা দেশীয় মাহুত। সুজার নির্দেশে মাহুতটিকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে হাত বেঁধে দাঁড় করানো হলো হাতিগুলোর সামনে। সরাসরি লোকটার কোমর বরাবর গুলি চালালেন সুজা। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। পাছার মাংস উড়ে গেছে মাহুতটির। ঠিক একই সময় শিং উঁচিয়ে বিশালাকার এক বুনো মোষ তেড়ে আসতে থাকলো আহত মাহুতের দিকেই। পাশ হতে রক্ষীরা ছুটে পালালো। মোষটির সূঁচালো শিং সরাসরি গেঁথে গেল মাহুতের শরীরে। তুঘরিলের গুলি পশুটির পাঁজর ভেদ করার আগেই বেচারা মাহুতের নিষ্প্রাণ দেহ ঝুলতে থাকলো সেই মোষের শিং-এর আগায়। দুমড়ে মুচড়ে মৃত মোষের নিচে চাপা পড়লো অর্ধনগ্ন মাহুতটির নিষ্প্রাণ দেহ। চোখের সামনে এমন নৃশংসতায় কেঁপে গেলেও জয়নুল চেহারায় তা প্রকাশ করলেন না। অন্যেরা বাক্যহারা হয়ে পড়লেন এমন দৃশ্যে। মাথা নিচু করে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন তুঘরিল। অনেক নির্মমতা তিনি দেখেছেন মুঘল রাজ পরিবারে। কিন্তু এমনটা আর দেখেন নি তুঘরিল মিঞা। (চলবে)
×