ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মণীশ রায়

জবাফুল

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

জবাফুল

ওরা চারজন। হাইওয়ের পাশে বাজার ঘেঁষা যে একলা অশ্বত্থতলা সেখানে বসে ঝিমুচ্ছিল; বাংলা মদের তীব্র নেশায় একেবারে ওলটপালট। এ জায়গাটা সন্ধ্যার পর এমনিতেই নিরিবিলি নির্জন; নিশি রাতে একেবারে ভুতুড়ে কাকতাড়ুয়া। শুধু মাঝে মাঝে হাইওয়ের এক-দুটো ট্রাক-বাস বজ্রপাতের আলোয় ঝলসে দিয়ে যাচ্ছে এখানটা। তাতেই চারজন মহা বিরক্ত; মুখে খিস্তি; একটুবাদে অন্ধকারে ফের সব তলিয়ে গেলে খিকখিক হাসির ঢেউ। তখন চারপাশের সুনসান নীরবতা মাতালদের সঙ্গে কথা কয়। মাঝে মাঝে মাথার ওপর পাখিদের ডানা ঝাপটানি; ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু অশ্বত্থের পাতা চুইয়ে নিচে শুকনো খরখরে ঝরাপাতার শরীরে পড়ে; শব্দ ওঠে, ফর...ফর...ফর। যেন কোন বিড়ালছানা সতর্ক পা ফেলে মরা পাতার ওপর দিয়ে হাঁটছে। চোখের সামনে হিমমাখা ফ্যাকাশে অন্ধকার; চারজনই জানে, দিনের বেলায় পাকা ধানের ভারে ন্যাতানো জমিগুলো যে স্বপ্নের খোরাক হয় সবার চোখে, রাতের বেলায় সেগুলো অথৈ অন্ধকার আর শীতের ভেজা শিশিরের ভেতর ডুব দিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকে। ওদিকে চোখ পড়লে আঁধার-কানা চোখে ঠিকই সেই রূপ তারা দেখতে পায়। সিদু টুডু এখন আর বাপদাদার ভিটায় থাকে না। সে এইট পাস করার পর ঢাকায় এসে একটা কারখানায় কাজ জুটিয়েছে। সাজপোশাক বাঙালীদের মতো; কথাবার্তায় বোঝার জো নেই, সে বাঙালী নয়। বাকি তিনজন ওর শৈশবের বন্ধু। গ্রামে কৃষিকাজ করে পেট চালায়। ইচ্ছে আছে, সিদুর মতো ওদেরও শহরে চলে যাওয়ার। কারণ, সাত পুরুষের যে জমিতে এখন ওরা চাষবাস করে চলছে সেটা নাকি ওদের নয়, মিলের। সরকার কখন যে কলমের মারপ্যাঁচে ওদের বঞ্চিত করে মাইল মাইল জমি চিনিকলকে লিখে দিয়েছে তা ওরা বুঝতেই পারেনি। যখন বুঝতে পেরেছে তখন আর কিছু করার নেই। মুখ বুজে নিজ ঘরে পড়শীর মতো বাস করছে বছরের পর বছর। এদ্দিন ভালই চলছিল; হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে ভূমিকম্প শুরু হলো; এই বুঝি ওদের উচ্ছেদ করতে তেড়ে আসছে হিংস্র উইপোকার দল। গত সপ্তাহে তো গ্রামজুড়ে চাউরই হয়ে গেল, পুলিশ নিয়ে মিলের শ্রমিকরা ঘরবাড়ি জ্বালাতে আসছে; হয়ত গুলিগালাও চলতে পারে। হররোজ এ রকম গুজব রটে আর ওরা সতর্ক হয়। তীর-ধনুক-লাঠি-বল্লম নিয়ে সজাগ ও সন্দেহের চোখে চারপাশে তাকায়; কেবলি শঙ্কাÑ এই বুঝি বর্গিরা এসে পাকা ধান লুট করে নিয়ে যাবে; সারা বছরের ঘামঝরা কষ্টের মুখে শীতল জল ঢেলে দেবে। কানু সোরেন, জিতেন মুর্মু, মার্শাল, সুবল হাঁসদাকÑ এরা সবাই এখানকার তাগড়া যুবক। রাতের বেলায় পালা করে নিজেদের ধানের জমি আর ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর অবধি প্রতিদিন একই রকম দায়িত্ব। চোখেমুখে সবার উৎকণ্ঠা; তবু এরই ভেতর গর্জে ওঠে, ‘সাবধান।’ হাতে ধরা টিনের ঢেঁড়িতে বাড়ি দিয়ে প্রমাণ করতে চায়Ñ ওরাও যোদ্ধাজাতি; যুদ্ধ করে বাপ দাদার জমিজেরাত ওরা রক্ষা করবে। ওদের পিঠে তীরধনুক; হাতে তেলদেয়া বাঁশের লাঠি আর বুকে অসীম মনোবল; ওরা হারবে না; হারতে ওরা জানে না। এ রকম এক দুঃসময়ে সিদু কামকাজ ফেলে ঢাকা থেকে চলে এসেছে গ্রামে। দুর্দিনে ওকে পেয়ে বন্ধুরা মহাখুশি। এ উপলক্ষে বুনো বেজির মাংস আগেই ঝলসে নিয়ে এসেছে মার্শাল। সুবল এনেছে দুটো বাংলা পাঁইট। ব্যস, পাহারা-টাহারা ভুলে ওরা চার বন্ধু মজে রয়েছে মৌজমাস্তির চিরচেনা আনন্দে। দীর্ঘ অদর্শনে হাজার কথা জমে রয়েছে বন্ধুদের অন্তরে। সেগুলোই এক এক করে এখন বেরোচ্ছে। সহসা সিদু হাঃ হাঃ করে কেঁদে মুখ লুকাল মার্শালের কোলে। শিকারি বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র ও সপ্রতিভ মার্শাল; যে কোন আচমকা পরিস্থিতি সে বুঝে ফেলতে পারে। মাথায় হাত বুলিয়ে ও উত্তর দিল, ‘কান্দিস ক্যানে? ছামনের বাহে উচ্ছবে লছমিরে তুই সিঁন্দুর পরাইয়া দিবি। কোন্ ছালা আটকাবে তুয়ারে? ফাটাইয়া দিমু নি।’ সিদু অন্ধকারে মুখ তুলে তাকায় বন্ধুর দিকে। ওর চোখের সামনে লছমি; ফনফনিয়ে ওঠা পুঁইলতার মতো শরীর; গুঁইসাপের মতো চলন; বকফুলের মতো চোখের গড়ন; গা ঘেঁষে দাঁড়ালে ছাতিম ফুলের গন্ধ বিবশ করে দেয় শরীর। একবার সোহরাই উৎসবের দিন ওকে চোখের সামনে পেয়ে বলেই দিল সিদুর মনের কথা। ওমা, সঙ্গে সঙ্গে ফুস করে ওঠে লছমি, ‘তুই আমার পিছু নিবি না। তোরে আমার ভাল লাগে না। বোঞ্চার দেবের দোহাই লাগে।’ বলার সময় লছমিকে বড় বেশি নিষ্ঠুর মনে হয়। দুঃসহ এ ব্যথা সহ্য করতে না পেরে সিদু শেষ পর্যন্ত গ্রামটাই ছেড়ে দেয়। আশ্রয় নেয় ঢাকায়। তবু চোখের সামনে থেকে লছমির ছায়া যায় না। এ এক ঘোর ওকে গিলে খেয়েছে। সুবল আর কানুর জীবনেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। দুজনই মেলায় গিয়ে অনিচ্ছুক কনেদের সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। এখন ওরা ওদের বাল-বাচ্চার মা হয়ে খ্যাটখ্যাটে দাসী বনে গেছে। বন্ধুরাই বুদ্ধি দিল, ‘তুই অত ভাবিস নে হে। লছমিরে মেলায় ধরে আমাদের মতন কপালে সিন্দুর লেপে দে। মুরগি আর খকখক করতে পারবে নাই।’ বলেই অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল। সিদু ওদের মতো অত একগুঁয়ে নয় ; ওর কথা হচ্ছে, জোর করে সিঁদুর দিয়ে বাধ্য করা নয়; বরং ভালবাসায় লছমির মন মজাতে চায় সে। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছে তত বেয়াড়া হয়ে পড়ছে মন; জিতেনের বোন বান্ধবী রাধার কাছে লছমি নাকি মন্তব্য ঝেড়েছে, ‘চিকা খেয়ে খেয়ে সিদুর চেহারাটা কী হয়েছে দেখেছিস? আমি ওরে ভালবাসতে পারুম নাই। ’ কথাটা বেয়ে বেয়ে সিদুর কানে আসায় সে আরও উতলা হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে লছমি ওকে মাদলের কাঠি বানিয়ে ফেলছে। যতবার টোকা দেয় তত বলে, ‘লছমি লছমি।’ মাগুর মাছের মতন ও তড়পাচ্ছে; কিছুতেই শান্তি মিলছে না। ঢাকায় থাকলেও দিনে অন্তত ছবার মোবাইলে কথাবার্তা চলে বন্ধুদের সঙ্গে; প্রসঙ্গ একটাইÑ মেলায় লছমির সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে ওকে স্ত্রী হিসেবে বাহুডোরে টেনে নেয়া। সব মোটামুটি ঠিকঠাক। জোর জবরদস্তির দিকে সিদুর মন কিছুতেই যেতে চায় না, তবু। কিন্তু হঠাৎ করে মিলের লোকজন ওদের জমি ছেড়ে দিতে হুকুম দিল। ছাড়তে হবে; নইলে বাড়িঘরে আগুন দেবে; পুলিশ এসে গুলি করবে; ওদের বাপদাদার ভালবাসার ভিটামাটি সব অবৈধ, সব বেআইনী। বুড়ো নরেন বাস্কে দাওয়ায় বসে ওদের বলল, ‘জঙ্গল ছাপ করে, বাঘভালুক খেদায়া এ জাগায় বাস কচ্চি ব্রিটিশদের ছময় থিকা। আর অহন বাঙ্গালরা কয় এ জাগা হামাগো না। ভূমিসন্তান সান্তালিরা নাকি পরবাসী; থানকিলা নয় হে। কিছু কর তরা।’ দড়ির ছোবরার মতো চিমসানো মুখের মাঝখানে দুটো ঘোলা চোখ। সেখানে স্বপ্ন নেই; দ্রোহ নেই। যা আছে তা কেবল অসহায় এক বুড়োর আর্তনাদ। আর কাউকে না পেয়ে নরেন বুড়োর ডাকেই এখন সবাই একতাবদ্ধ; সিদুও বুকের ভেতর সংগ্রামী জোশ নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে এসেছে গ্রামে। বন্ধুদের সঙ্গে সেও পাহারা দিচ্ছে বাপদাদার জমি ও ঝুপড়ি ঘরগুলো। তবু কেন যে ঘুরে ফিরে লছমি চলে আসে অন্তরে। নেশার ঘোরে মাথা ঝিমঝিম করছে; পা টলটলায়মান; হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা ফ্লাশলাইটগুলো চোখে কামড় বসাতেই চেঁচিয়ে উঠছে, ‘ছালা শুয়োরের বাইচ্ছা। ছালা হারামির পোলা। মস্তানি ফলাও?’ পরক্ষণে সব সুনসান; নিশুতি রাত হিমচাদর হয়ে যায় ; মাথার উপর অশ্বত্থর ডালে পাখিদের আচমকা ডানাঝাপটানি আর বহুদূর থেকে আসা বেওয়ারিশ কুকুরের ঘেউ ধ্বনি ছাড়া আর কোন রা-শব্দ নেই। ওরা কেবল এক হাত থেকে আরেক হাতে চালান করে দিচ্ছে বোতল। বেজির পোড়ানো মাংস বহু আগেই শেষ। এখন যে খানিকটা দ্রব্য বোতলের তলানি হয়ে রয়েছে সেটা নিয়েই কাড়াকাড়ি। মার্শাল সিদুর কাঁধে হাত রেখে সান্ত¡না দেয়, ‘চিন্তা করিছ নাই। লছমি তোরই হবেক। বাহের মেলায় ছিন্দুর দিয়ে এক্কেরে চেপে ধইরবি গলা।’ সবাই ওকে সমর্থন জানায়। কিন্তু সিদু যে কথা কখনও বলতে পারেনি আজ সে কথাই নেশার ঘোরে বলে দিল, ‘নারে। আমি জবরদস্তি করতে পারব নাই। আমি ওরে ভালবাইসেই ঘরে তুলব। দেখিছ।’ সবাই এবার হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। যেন এ রকম অদ্ভুত কথা কখনও কোন সাঁওতাল পুরুষ এ তল্লাটে বলেনি। জিতেন খ্যাক খ্যাক করতে করতে উত্তর দেয়, ‘তুই ব্যাটা পুরুছ নস। তুই তো ছালা চিকাও শিকার করতে পারবি না। মাগিবেটি তো বহুত দূর।’ বলে সে হাসে। ওর হাসি সংক্রামক হয়ে ঘুরতে থাকে সবার চেহারায়। সিদু ভড়কে না গিয়ে উত্তর দেয়, ‘কাইল সকালে এই জবা ফুলটা লছমিরে দিয়ে কব, আমারে ভালবাছ; নইলে ভালবাছা আর পাবি নাই।’ সুবল চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ভাল‘। মার্শাল ওর হাতের টর্চটা জ্বালায়; সেই আলোয় নেশাতুর ক’টি চোখ দেখতে পায় সিদুর হাতে একটি শুকনো জবাফুল ভালবাসার উপহার হয়ে জ্বল জ্বল করছে। মার্শালের গলায় ঝুলতে থাকা পবিত্র ক্রসটি ফুলটিকে স্পর্শ করে; মনে হচ্ছে এইমাত্র আলতো করে চুমু খেল। দৃশ্যটি ওদের হাসির খোরাক হয়; ওরা হেসে ওঠে তুমুলভাবে। ওদের হাসি থেকে একরাশ ব্যঙ্গ আর বিদ্রƒপ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এ সময় হাইওয়ে ধরে হেডলাইটের তীব্র আলো ছড়িয়ে একটি গাড়িকে ওদের দিকে তেড়ে আসতে দেখে ওরা। মার্শালের রাগ হয়; মাথায় ঝলক ঝলক রক্ত বলক তোলে। মুখে খিস্তি, ‘ছালা হারামির পুত। ছালা শুয়োরের বাচ্চা। তীর দিয়ে গাইথে দেব মাটির সনে। ছালা।’ সঙ্গে সঙ্গে জিতেন, কানু ও সুবলের কণ্ঠ থেকেও আগুনের ফুল্কির মতো অজস্র অশ্রাব্য গালি বেরোতে শুরু করে। মনে হচ্ছে, এটা কোন যন্ত্রযান নয়, ওদের ভিটি ছাড়া করার ষড়যন্ত্রকারী মিল কর্তৃপক্ষ। মার্শাল আরও উত্তেজিত হয়ে ছুটে যায় বাজারের ভেতর; সেখান থেকে একটা আস্ত ইট নিয়ে এসে দাঁড়ায় আলোটার সামনে। দ্রুতযানটি যত তেড়ে আসছে তত ভেতরকার ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে ওদের; বিষবাহী অফুরান তীরের ফলার মতো অবিরাম ওদের মুখ থেকে খিস্তিখেউর বের হচ্ছে। আলোটা খুব কাছে চলে আসতেই মার্শাল গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাতের আস্ত ইটটি ছুড়ে মারে সেদিকে। তারপর কারও কিছু মনে নেই। পরদিন সবাই দেখতে পেল, চারজন প্রাণহীন নিথর রক্তাক্ত সাঁওতাল যুবক একটি ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। এর ভেতর একজনের হাতের মুঠোয় ধরা একটি শুকনো জবাফুল।
×