ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমিনুল ইসলাম

চর্যাপদ’র ভূমি ॥ দুর্বোধ্যতা নয় রহস্যময়তা কবিতার প্রাণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

চর্যাপদ’র ভূমি ॥ দুর্বোধ্যতা নয় রহস্যময়তা কবিতার প্রাণ

প্রকৃতির মাঝে, বিশ্বলোকে আমি দেখি কবিতার ছন্দ এবং বহুরৈখিক সৌন্দর্যের প্রতিভাস। ‘লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি / আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।’-আল মাহমুদের এমনতর অনুভূতির মাঝে আমি আমার নিজের কাব্যানুভূতির কথা ব্যক্ত হতে দেখি। সবাই যা দেখেন, যতখানি দেখেন, কবি দেখেন তারও বেশি কিছু, তারও বেশি অনেকখানি। অনেক বিষয় আছে, যাদের এ কথায় বলা যায় অনির্বচনীয় অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য। সেসবের প্রকাশের মাধ্যমও কবিতা। কবির কাজ হচ্ছে অনির্বচনীয়ের মুখে ভাষা দান, অশ্রুতির অস্তিত্বে শব্দ জুড়ে দেয়া এবং অদৃশ্যের শরীরে রূপের প্রলেপ লাগিয়ে উপস্থাপন। কবিদের ইনটুইশান বা সংজ্ঞা অত্যন্ত প্রবল, ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর, অনুভব-ক্ষমতা সুগভীর এবং দৃষ্টিশক্তি নিবিড়ভাবে অন্তর্ভেদী। সেজন্য তাদের উপলব্ধি-দর্শন-শ্রবণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর দশজন মানুষের থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র হয়। তারা তাদের সেই স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞানকে শিল্পে রূপ দেন অর্থাৎ কবিতা করে তোলেন। সেই সৃষ্টি হয়ে ওঠে প্রাতিস্বিক। তাদের ব্যক্তিগত বেদনাও অনেক সময় অদ্ভুত ধরনের হয়ে থাকে। সেই অদ্ভুত বেদনা মূর্তি লাভ করে কবিতায়। তবে তার প্রকাশ সংবেদনশীল মনকে স্পর্শ করতে পারলে,- পাঠকের সৌন্দর্য-পিপাসার জল হলে, তবেই তা সার্থক সৃষ্টিতে উন্নীত হয়। অনুভূতি-অনুভবটাই মুখ্য বিষয়। তার সাথে চিত্রকল্প বা কল্পচিত্র উদ্ভাসিত করে তুলতে পারে কিছু নান্দনিক সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে ভাল লাগার মতো কিছু একটা দাঁড়ালেই হয়। কবিতা হচ্ছে বোঝা আর না বোঝার মাঝামাঝি শিল্প। কবি কিছুটা বলেন, বাকিটা পাঠক তার মতো করে বুঝে নেন, কিংবা আবিষ্কার করেন। কবিতা রহস্যময় সৃষ্টি। দুর্বোধ্যতা নয়, রহস্যময়তা হচ্ছে কবিতার প্রাণ। চেনা চেনা অথচ অচেনা। জানা জানা অথচ অনেকখানি আজানা। উৎকৃষ্ট কবিতা হয় সমুদ্রের মতো গভীর অথচ স্বচ্ছ, ড্রেনের পানির মতো অগভীর ও ঘোলাটে নয়। ভাল কবিতা আকর্ষণ সৃষ্টি করে; পাঠকমন ডুবুরি হয়ে ডুব দেয় অথবা হাওয়ায় পাল তুলে নৌভ্রমণে পাড়ি দেয় অথবা সমুদ্রের সৈকতে দাঁড়িয়ে মুক্ত হাওয়ায় ভরে নেয় তপ্তপ্রাণ। কিন্তু কোন অবস্থাতেই তার আবেদন নিঃশেষে ফুরিয়ে যায় না। তাছাড়া পাঠকবিশেষে তার আবেদন ভিন্ন হয়ে ওঠে। কারণ উৎকৃষ্ট কবিতা আবেদনে-অর্থময়তায়-সৌন্দর্যে বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক আকর্ষণ ধারণ করে রাখে। উৎকৃষ্ট কবিতা যেন বনভূমি-কখনো তার গহনতা, কখনো রঙের প্রগাঢ়তা, কখনো বৃক্ষের বৈচিত্র্য, কখনো বৃক্ষের শাখায় বেজে ওঠা বাতাসের কোরাস, কখনো গভীর ছায়ার বিস্তারিত প্রশান্তি, কখনো বা একটি হরিণীর একজোড়া চোখের উঁকিঝুঁকিÑভাল লাগার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। পুরাতন শব্দকে নতুন ব্যঞ্জনায় ব্যবহারকরণ, প্রচলিত শব্দের সঙ্গে অপ্রচলিত বা নতুন শব্দের বিবাহদান, অতীতের মিথ-কাহিনীকে প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে নতুন ধারণা নির্মাণে ব্যবহার, কবিতায় শব্দের নতুন চাবিকাঠি নির্মাণ প্রভৃতি সৃষ্টিশৈলী বা টেকনিক একটি কবিতাকে অভিনব মহিমায় উত্তীর্ণ ও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সফল সহায়তা দেয়।
×