ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি কর্মে বাউল প্রভাব

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি কর্মে বাউল প্রভাব

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন এমন এক সময় যখন বাংলাদেশের জনসংস্কৃতি ছিল অতিমাত্রায় প্রাণবন্ত। তার বৈভব কেড়ে নেয়ার জন্য সর্বগ্রাসী যান্ত্রিক নাগরিক সভ্যতাও তেমন তৎপর হয়ে ওঠেনি। গ্রামলক্ষ্মীর কাছ থেকে সেই ঐশ্বর্য অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করবার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী জেলার পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক সফরকালে দেশের লোকসংস্কৃতির বাউল বাতাস স্পর্শলাভের সুযোগ পেয়েছিলেন কবিগুরু। বহুদিন পল্লীর সাদামাটা মানুষগুলোর মধ্যে বসবাস করে তাদের জীবনগঙ্গায় অবগাহন করে তিনি এক অন্তরঙ্গ পরিচয় লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। এই পরিচয় কবির শিল্প জীবনের পক্ষে এক মহা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল পরবর্তীকালে। পল্লীর উদার মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ তাকে দিয়েছিল মুক্তির নববারতা। পল্লী মানুষের ধ্যান, চিন্তা, অনুভূতি ও কর্মের জগতে তিনি পেলেন তার শিল্পী আত্মার জারক রস। মোটকথা গ্রামীণ জীবন তথা গ্রাম সংস্কৃতির সঙ্গে এই অন্তরঙ্গ যোগ রবীন্দ্র সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক জীবন মুক্তির পথকে নিশ্চিতরূপে প্রশস্ত করেছিল। রবীন্দ্র প্রতিভা আজীবন পুষ্টি খুঁজে পেয়েছে এই জনসংস্কৃতির কাছে- এর রসধারা থেকে সঞ্চায়ন করেছে শক্তিধারা। রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গে বিচিত্র বর্ণালীর সঞ্চারণে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জনসংস্কৃতির কোলে চড়ে লোকশিল্প যেভাবে বাউলের একতারা হাতে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে এবং এই সংস্কৃতির প্রতি কবির আগ্রহ তাঁর অনুভব ও কর্মেও ঠিক পরিস্ফুট হয়েছে। বলা বাহুল্য, ‘প্রাকৃত জনের’ ভাব ও ভাষার কীর্তি ও কাহিনীর প্রত্যক্ষ স্পর্শলাভের ব্যাকুলতাই তাকে জনসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। এ আকর্ষণ যে একটা সাময়িক আবেগ নয়- তা তার ব্যাপক কর্মোদ্যোগ থেকেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল ধরে একদিকে পুরাতাত্ত্বিক, মানব বিজ্ঞানীর বেশে বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। তাদের স্বরূপ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যানের প্রয়াস পেয়েছেন- অপরদিকেৃ ছড়া, ব্রতকথা, গ্রাম্যকথা ও গানের ভাব-ভাষার অনায়াস ব্যঞ্জনা, মাধুর্য ও সারল্য, ছন্দ ও সুরের অপরূপ সঙ্গতি, তার দেশীয় রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় সত্তাকে নতুন যুগের সাহিত্য সৃষ্টির পাথেয় রূপে ব্যাপকভাবে প্রয়োগের অনুশীলন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে, সাহিত্য-সঙ্গীতে জাত লোকশিল্পের স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাবলীলতা লক্ষ্য করা যায়। ১২৯০ সালের বৈশাখ সংখ্যা ‘ভারতীতে সঙ্গীত সংগ্রহ’ নামে বাউল গানের একটি সঙ্কলন গ্রন্থের সমালোচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম লোকশিল্পে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। বাউল গানের এই সমালোচনা প্রচেষ্টা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, পূর্বাহ্নেই তাঁর কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। ‘বাউলের গানগুলো তার ওপর সোনার ফসলের বীজ ছড়িয়ে দিল।’ শ্রী বিনয় ঘোষ এই সংগ্রহের গানটি উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন- ‘আমি কে তাই আমি জানলেম না, আমি আমি করি, কিন্তু আমি আমার ঠিক হইল না। কড়ায় কড়ায় কড়ি গণি, চার কড়ায় এক গ-া গণি কোথা হইতে এলাম আমি, তারে কই গণি-’ গানটি রবীন্দ্র চিন্তার বিশ্বমুখী অভিযানে নিভৃত নাবিকের কাজ করেছে। বস্তুত এই বাউল গানগুলোর মধ্য দিয়ে এক রহস্যময় জগতের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল তার কাছে। তিনি পেয়েছিলেন আধ্যাত্ম প্রবেশের স্বর্ণসিঁড়ির সন্ধান। তাই অচিরেই যখন- ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যেরে। হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশ্যে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে- গানটির মধ্যে উপনিষদের ‘অন্তরতর যদয়মাত্ম’ বাণীকে বাউলের মুখে ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলেন, তখন সে অভিজ্ঞতার অপরূপ হয়ে বেজে উঠেছিল তাঁর প্রাণে। অনন্তের সঙ্গে মিলন ব্যাকুল সমগ্র মানবতার কান্নাই যেন ব্যঞ্জিত হয়ে ফিরছিল সহজ সরল সুরে। শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগণ হরকরার লেখা এই বাউল গান কবি মুগ্ধ বিস্ময়ে এ সম্পর্ক মন্তব্য করেছেন- ‘অপ-িতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম, তার গেঁয়ো সুরে, সহজ ভাষায়-যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনা অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু-তারই কান্নার সুর- তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে।’ মোটকথা বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে কবির প্রাথমিক পরিচয় বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চল। লোক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বাসনা কবিচিত্তে জাগে। সে কারণেই কবি লোক সাহিত্যের নিদর্শন সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিলেন। ১৩০১ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় দুই পর্যায়ে ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ সম্পর্কে একটি অতি সরস নিবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধের শেষে তিনি ৮১টি ছড়ার একটি সংগ্রহ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছিলেন। ১৩০১-২ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তাঁর মেয়েলী ছড়ার সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। এসব ছাড়া ১৩২২ সালের প্রবাসীতে হারামনি বিভাগে তাঁর সংগৃহীত লালনের কুড়িটি গান প্রকাশিত হয়েছিল। লোক সাহিত্যের নিদর্শন সংগ্রহ, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সমালোচনাতেই রবীন্দ্রনাথের লোকসংস্কৃতি চর্চা সীমাবদ্ধ থাকেনি। রবীন্দ্রনাথ এটা ভাল করেই জানতেন যে সকল সুসমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতিরই যেমন একটি ভাবগত ভিত্তি আছে- যার পরিচয় পাওয়া যায় লোকসাহিত্যে, তেমনি আছে একটি বস্তুগত ভিত্তি- যা লোকশিল্পীর নানাবিধ শিল্পকর্মে সদা প্রকাশমান। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের লোকসংস্কতির এই দিকটি সম্পর্কেও যে সক্রিয় চেতনার পরিচয় দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমরা সুনির্দিষ্ট সংবাদ পাই কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের প্রদত্ত বিবরণ থেকে। ১৯১৫-১৬ সালের দিকে শিলাইদহের পদ্মবক্ষে কবির সঙ্গে কিছুদিন কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল তার। প্রসঙ্গক্রমে একদিন কবি তাঁকে কিছু লোকশিল্পের সংগ্রহ দেখিয়েছিলেন- ‘আমি কিছুদিন যাবত একটা বিষয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন বোধ করিতেছি; বাংলার নিজস্ব আর্ট আইডিয়া ক্রমেই বিদেশী প্রভাবে নষ্ট হইয়া যাইতেছে, আর কিছুদিন পর আমাদের খাঁটি দেশীয় শিল্পের নিদর্শন লোপ পাইবে। তাই আমি এই সকল নমুনা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি।’ লোকসাহিত্য ও লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ এবং সে সবের যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়াসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের জনসংস্কৃতির সঙ্গে যে নিবিড় অন্তরঙ্গ পরিচয় স্থাপনে সমর্থ হয়েছিলেন, তা তার নিজস্ব সৃষ্টি চেতনাকে। অনেকটাই পরিপুষ্ট করেছিল। লোকসাহিত্যে বিশ্বিত অনয়াস, স্বচ্ছন্দ গতি লোকজীবনের ছবি কবিকে বস্তুভার মুক্ত জীবনের স্বস্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ করেছে। লোককবির সহজ সরল ও অকপট অধ্যাত্ম ভাবনা, অধ্যাত্ম জীবনে শ্রদ্ধাশীল কবিকে শাস্ত্রাচারের গ-ির বাইরে মানবসত্যকে সহজভাবে উপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অসীম সঞ্চারী অনুভবের গৃঢ়তায় লোকসঙ্গীতের অন্তর্গুঢ় ভাবানুভূতির ছায়াপাত ঘটেছে। লোকসঙ্গীতের সুরধারার মূর্ছনাও তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতে শোনা যায়। লোককাব্যের ছন্দ, লোকসঙ্গীতের রাগরাগিনী রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও ছন্দে নতুন তরঙ্গ দোলা সৃষ্টি করেছে। লোকসাহিত্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত বাংলাভাষার শব্দলোকে প্রবেশ করে ‘খাঁটি বাংলাভাষার যাদুকর স্রষ্টা’ হতে পেরেছেন বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোকশিল্পের অনেক প্রবাহই এসে রবীন্দ্র সাহিত্যের ধারায় মিলেছে। তবে রবীন্দ্রনাথের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের বাউল কবিরা। সর্ববন্ধনহীন সংস্কার, প্রথা ও আচারের দাসত্ব হতে মুক্ত বাউল সাধকদের সাধনা, মানবতাবাদী অধ্যাত্ম রসপিপাসু রবীন্দ্রনাথের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে বাউল প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। ‘লোক মানুষের প্রতিমূর্তি’ বাউলের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর কাব্য-সঙ্গীত, গল্প উপন্যাস ও দার্শনিক প্রবন্ধের ‘বিচিত্র ভাবরসের তরঙ্গশীর্ষে’ বার বার। বাউল কবি তাঁর ধর্ম-দর্শন চিন্তার দিগদর্শনীতে অনেকটাই যেন পথনির্দেশকের কাজ করছে। তার সহজ ব্যাখ্যা বাউল কবির ‘মনের মানুষে’র অনুধ্যানে চমৎকারে ফুটে উঠেছে। তাই তো বাউল তার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। তার সাহিত্যকর্মের যত্রযত্র সে জন্যই বাউলের উপস্থিতি চোখে পড়ে। ‘গোরা’ উপন্যাসে দেখা যায়- ‘কাজের শহর কঠিন হৃদয়’ কলকাতার রাস্তার ধারে আলখাল্লী পরা বাউল উপস্থিত তার কণ্ঠে অন্তর ব্যাকুল করা গান- ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায় ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।’ ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগী এবং ‘ফাল্গুনী’র অন্ধ বাউলও আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। রবীন্দ্রনাথ ধনঞ্জয় বৈরাগী ও অন্ধ বাউলের নৃত্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের জীবনের আনন্দের স্বাদ পেতে চেয়েছিলেন। এই বাউলের স্মৃতিই মন্থন করে তিনি অন্যত্র বলেছেন ‘আমার মনে আছে তখন আমার নবীন বয়স-শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল, কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে... আবার শিলাইদহের পদ্মার তীরে বাউল সাধকের একতারা হাতে চলার দৃশ্য অমর হয়ে আছে কবির কবিতায়- ‘কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মা নদীর ধারে। যে নদীর নেই কোন দ্বিধা পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙ্গে ফেলতে দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে ‘মনের মানুষকে সন্ধান করবার গভীর নির্জন পথে’ বাউল দর্শনের যে জিনিসটা কবির সবচেয়ে ভাল লেগেছিল তা হচ্ছে তাদের ‘সমস্ত সামাজিক সংস্কার বিধিনিষেধ, প্রথা, রীতিনীতির বাইরে একান্ত সহজভাবে রূপের মধ্যে অরূপের, সীমার মধ্যে অসীমের জন্য ব্যাকুলতা।’ রবীন্দ্র দর্শনের মূল কথাও তাই। রবীন্দ্রনাথ পুলকিত হয়েছিল বাউল চিন্তার সঙ্গে নিজস্ব দর্শনের ঘনিষ্ঠ মিল দেখে। তিনি আরও পুলকিত বোধ করেছিলেন এই ভেবে জ্ঞানের কঠোর তপস্যার ‘ক্ষুরাস্য ধারা’ নিশিত্যয়া’ পথে চলে উপনিষদের কবি যে সত্যে ফৌঁছেছেনÑ বাউল কবিরা। হৃদয়ের পথে অনায়াসে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। বাংলাদেশের লোকায়ত ধর্মদর্শন এই বাউল দর্শন। লোক জীবনসমুত্থিত বলেই রবীন্দ্রনাথ একে ‘জনগণের দর্শন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই লোকায়ত দর্শনের কাছে তাঁর ঋণ তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। বাউলের ‘মনের মানুষ’ই যে পরবর্তীকালে কবির কাব্যে রূপান্তরিত হয়ে জীবন দেবতারূপে দেখা দিয়েছিল। রীবন্দ্রনাথ তার ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যায় অন্যত্রও বাউল গানের কাছে তার ঋণের কথা স্বীকার করেছেন- ‘শান্তি নিকেতন’ প্রবন্ধাবলী ও অন্যত্র বাউল সঙ্গীতের পৌনঃপুনিক উদ্ধৃতি তারই প্রমাণ। বাংলা লোকসাহিত্যের সম্পদের মধ্যে এই বাউল গানই রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার ওপর যেমন বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মেও বাউল গানের প্রভাবই বেশি কার্যকরী হয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যে তাঁর রচিত সঙ্গীতেই এ প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ সম্পর্কে কবি স্বয়ং বলেছেন, ‘আমার অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রূপরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে।’ রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে বাউল সঙ্গীতের ভাব ও সুরের যেমন রেশ পাওয়া যায়, অনেক সঙ্গীতে আবার সুরটুকুই শুধু ফুটে উঠেছে। কোথাও বাউল সুর ভিন্ন সুরের মিশ্রণে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। বাউল সুরে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সঙ্গীত হচ্ছে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আমার দেশের মাটি’, নিশিদিন ভরসা রাখিস’, ‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালবাসি’, ‘মেঘের কোলে কোলে’, ‘মালা হাতে খসে পড়া’, আমি যখন ছিলাম অন্ধ’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, ‘ডাকব না ডাকব না’, ‘হে আকাশ-বিহারী নীরদ-বাহন জল’, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, আমি তখন ছিলেন মগণ’, ‘আমার প্রাণের সুধা আছে’, ‘আমার নাই বা হলো পারে যাওয়া’ ইত্যাদি। সমদ্র সাহিত্যকর্মে ডুব দিয়ে আধ্যাত্মিক আত্মজিজ্ঞাসায় যে গভীর জীবন রহস্য ধরার প্রয়াস চলেছে তা সাধারণ বিশ্বাস দ্বারাই যে বাউল মনে উপস্থিত হওয়া যায় সেই আকাক্সক্ষায় রবীন্দ্রনাথের তাড়িত চৈতন্য সর্বত্র আন্দোলিত। বস্তুত বাউল গানের সরণি ধরে অগ্রসর হয়েই রবীন্দ্রনাথ তার জীবনব্যাপী অধ্যাত্ম উৎকণ্ঠার অনেক সন্তোষজনক সমাধান সূত্র আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছিলেন। তার জীবন-দর্শন তথা ধর্মচিন্তায় বাউল প্রভাবের সূত্রপাত এখানেই হয়। এই বাউল গানের মধ্য দিয়েই তিনি জনহৃদপদ্মে বিরাজমান গ্রাম্য সাহিত্যের ঐশ্বর্য সম্পর্কে আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন।
×