ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোফাজ্জল হোসেন

পুরাকীর্তির জনপদ বাগেরহাট

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

পুরাকীর্তির জনপদ বাগেরহাট

বাগেরহাট একটি প্রাচীন জনপদ। দেশের দক্ষিণপ্রান্তে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের পাদপীঠে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। পূর্বে খলিফাতাবাদ নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ এ জেলার অদুরে অবস্থিত। বিশ্বমানবের ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কো পৃথিবীর যে কয়টি পুরাকীর্তির নির্দশন তালিকাভুক্ত করেছে তার মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ একটি। এছাড়াও অনান্য অনন্য কীর্তিও রয়েছে এই জনপদে। বাগেরহাট শহর থেকে প্রায় দুই মাইল দূরবর্তী রণবিজয়পুর গ্রামে খান জাহান আলী রোডের উত্তর পাশে বহুসংখ্যক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ, এর নামই ষাট গম্বুজ মসজিদ। এই ষাট গম্বুজ মসজিদকে অনেকে পীর খান জাহান আলীর অমরকীর্তি বলে ধারণা করেন। বাগেরহাটে রয়েছে তার নানা কীর্তি। এই অঞ্চলের সঙ্গে যে মহাপুরুষের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যার আগমনে এই পুণ্যভূমি ধন্য তিনি হযরত খান জাহান আলী। তাঁর আমলে এই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল এক সমৃদ্ধ জনপদে রূপান্তরিত হয়। তিনি ছিলেন একাধারে পীর ও শাসনকর্তা। তাঁর জন্মসাল ও স্থান কোথায় সে বিষয়ে ইতিহাসে কোন উল্লেখ নেই। তবে ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন, তিনি পারস্য দেশীয় মুসলমান ছিলেন। নিজের প্রতিভাবলে তিনি দিল্লীর সম্রাট মোহাম্মদ তোঘলকের মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হন। কথিত আছে, তিনি ১১ জন আউলিয়া ও ৬০ হাজার সৈন্যসহ দিল্লী হতে ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আগমন করেন। তিনি প্রথমে বারোবাজার এসে অনেক অনেকগুলো দীঘি, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। বারোবাজারের ঐতিহাসিক জরাজীর্ণ মসজিদটি আজও খান জাহানের কীর্তি ঘোষণা করছে। বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে খান জাহানের কীর্তিরাজি দীঘি, মসজিদ, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। খান জাহানের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ। হাবেলী পরগনায় ৩৬০টি দীঘি খনন ও ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন হজরত খান জাহান আলী। এসব অঞ্চলে কথিত আছে যে, এক রাতের মধ্যেই এসব দীঘি ও মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। দৈত্য ও জিনের দ্বারা। তার সর্বপ্রথম কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদের কাছে রয়েছে ঘোড়াদীঘি। এই দীঘির দৈর্ঘ্য ১০০০ হাত এবং প্রস্থে ৬০০ হাত। এই বিশালাকার দীঘির নাম নিয়ে আছে নানা প্রবাদ। একটি ঘোড়া এক দৌড়ে যতদূর গিয়েছিল ততদূর দীর্ঘ নাকি এই দীঘি খনন করা হয়েছিল। তাই এর নাম হয়েছে ঘোড়াদীঘি। আবার অনেকের মতে, এই স্থানটা ঘোড়াদৌড়ের মাঠ ছিল বলে তার নাম হয় ঘোড়াদীঘি। ঘোড়াদীঘির পূর্ব তীরে খান জাহানের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি এই ষাট গম্বুজ মসজিদ। দৈর্ঘ্যে ১৬০ ফুট এবং প্রস্থে ১০০ ফুট। ভেতরের গম্বুজের উচ্চতা ২২ ফুট। বিশাল হর্মের সম্মুখ দিকে মাঝখানে একটি বড় খিলানোর পাশে উভয় দিকে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে। প্রাচীরের প্রশস্ততা ৯ ফুট। ষাট গম্বুজ স্থাপত্য বৈচিত্র্যে ভাস্বর। গোলাকার গম্বুজের হেলানভাব, সরল অলঙ্করণ ও কার্নিশের বক্রতায় তোঘলক স্থাপত্যরীতির প্রভাব বিশেষভাবে পরিদৃষ্ট। এর ভেতর বাইরে ত্রিভুজাকার অংশে ফুল লতাপাতা ইত্যাদি পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে। মাঝে মধ্যে বহুগুন রঞ্জিত মীনা করা চাকচিক্যময় টালির ব্যবহার দৃষ্ট হয়। পূর্ব পশ্চিমে ৬০টি স্তম্ভের ওপর সাতটি করে এগার শ্রেণীতে সর্বমোট ৭৭টি গম্বুজ আচ্ছাদিত একটি আয়তাকার স্থাপত্য এটি। সত্তরটি গম্বুজ গোলাকৃতির, মধ্যের সারির সাতটি গম্বুজ চৌকোনাবিশিষ্ট। অনেকেই বলেন, ষাট গম্বুজের গম্বুজ সংখ্যা ষাটটি। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। গম্বুজ সংখ্যা মোট ৭৭টি। মিনারের গম্বুজ সংখ্যা ৪টি। মিনারসহ মোট গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮১। অসম্ভব রকমের সুন্দর এই পুরাকির্তী। একে বারে নিজেস্ব্য নির্মাণ শৈলিতে নির্মিত এই অনন্য স্থাপত্য। এক সময়ে ষাট গম্বুজ অট্টালিকার চতুর্দিক প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। এখন সে প্রাচীর নেই। এখন শুধু পূর্বদিকের তোরণসহ সামান্য দেয়াল দেখা যায়। খান জাহান আলীর দরগাহ আর একটি বিস্ময়কর কীর্তি। এখানে তার মাজারও অবস্থিত। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি এখানে কাটিয়েছেন বলে জানা যায়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই সমাধিসৌধের চারদিক দেয়াল বেষ্টিত । মাজারের প্রবেশপথে রয়েছে বৃহৎ তোরণ। দরগা ঘাট পাথর দিয়ে তৈরি। চারদিক থেকে সিড়ির মতো করে তিনটি ও নিচে ইটের একটি, এই চারটি স্তরে সাজিয়ে উপরে কবর আকৃতির অর্ধগোলাকৃতির একটি পাথর বসানো রয়েছে। এই দরগাহর সমস্ত পাথরেই কোরানের বিভিন্ন আয়াত, দোয়া-দরুদ আরবি ভাষায় লেখা আছে। হজরত খান জাহান আলীর মাজারের পশ্চিম পাশে পাথর দিয়ে তৈরি আর একটি মাজার আছে। এই মাজারটি তার প্রিয়সঙ্গী পীর মোহাম্মদ আবু তাহেরের মাজার। খান জাহান আলীর মাজার ঘেঁষেই যে দীঘি তার নাম খান জাহান আলী দীঘি। এলাকাবাসীদের কাছে তা খাঞ্জালি দীঘি নামে পরিচিত। এটাকে ঠাকুর দীঘিও বলা হয়। এই দীঘির চারদিককার তীর অনেক উঁচু। এক সময় দীঘির চারধারে চারটি বাঁধানো ঘাট ছিল। আজ তার ধ্বংসাবশেষ আছে। মাজারের সম্মুখের ঘাটটি নতুন করে বাঁধানো হয়েছে। এই দীঘির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট। এই দীঘিতেই রয়েছে কুমির। কালাপাড় ও ধলাপাড় নামে দুটি কুমিরের বংশধররা এখানে বাস করে। ডাক দিলে ওরা ঘাটে আসে। লোকেরা এদের জন্য মোরগ-খাসি ইত্যাদি নিয়ে যায়। খাঞ্জালি দীঘি বা ঠাকুর দীঘির পশ্চিমপারে নয় গম্বুজের একটি মসজিদ রয়েছে। সারিতে তিনটি করে নয় গম্বুজ মসজিদ দেখতে খুবই সুন্দর। পশ্চিম দিক ছাড়া সবদিকে ৩টি করে দরজা আছে। মসজিদের দেয়াল ২০ ফুট উঁচু। দেয়ালে বিভিন্ন ফুল ও লতাপাতা অঙ্কিত রয়েছে। গম্বুজগুলো ছয়টি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্তম্ভগুলোর একটিতে বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপের মতো গর্ত রয়েছে। প্রবাদ আছে, একদিন খান জাহান আলী পাথরটি শক্ত কিনা পরখ করার জন্য বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে পাথর সে চাপ সইতে না পেরে নরম হয়ে তার বুকে আঙ্গুলের ছাপ ধারণ করে নিয়েছিল। ভক্তরা এখনও এটি ভক্তিভরে চুমু খায়, ছুয়ে হাত বুকে লাগায়। হজরত খান জাহান আলীর মাজার থেকে কিছুদূর পশ্চিমে গেলে আর একটি মাজার চোখে পড়ে। এ মাজারটি জিন্দাপীরের মাজার বলে পরিচিত। এর আসল নাম সৈয়দ শাহ মুহম্মদ। তিনি একজন আউলিয়া ছিলেন। জিন্দাপীরের মাজারটি এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং এর আকৃতিতে খান জাহান আলীর মাজারের সঙ্গে মিল রয়েছে । জিন্দাপীর খান জাহান আলীর সমসাময়িক বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। তাকে তার প্রধান সহকর্মীদের একজন বলেও মনে করা হয়। খান জাহান আলীর মাজারের পশ্চিমে এবং জিন্দাপীরের মাজারের পূর্বদিকে একটি স্থান, ছিলিয়াখানা নামে পরিচিত। শোনা যায়, এখানে খান জাহান আলীর অস্ত্রাগার ছিল। ছিলিয়াখানা অর্থ অস্ত্রাগার। এখানে বড় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখন বিদ্যমান। জিন্দাপীরের মাজার থেকে কিছুদূর গেলেই কাজী বাড়ির কাছে আরও একটি মাজার দেখা যায় এটা ‘পাগলা পীরের মাজার’ নামে খ্যাত। আজও বাগেরহাটে জিন্দাপীরের সমাধি, খাঞ্জালি দীঘি, হোসেনশাহী মসজিদ ও পীর আলী মোহাম্মদ তাহেরের সমাধিতে প্রচুর ভক্তের আগমন হয়। খান জাহান আলী মসজিদ ও দীঘির পাশাপাশি যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছিলেন। তার নির্মিত রাস্তার মধ্যে সামন্তসেনা হতে পিলজঙ্গ পর্যন্ত ‘হাতি ধরার’ রাস্তা নামে একটি রাস্তা ছিল। এখনও সে রাস্তার চিহ্ন দেখা যায়। তাছাড়া ষাট গম্বুজ থেকে পশ্চিমমুখী সামন্তসেনা পর্যন্ত পাকা রাস্তার চিহ্ন এখনও আছে। এটাই খান জাহানের বৃহত্তম পাকা রাস্তা। এ ছাড়া ভেরব নদীর তীরে তার আমলের রাস্তা এখনও বিদ্যমান। খান জাহান বাগেরহাট অঞ্চলে ২৫-২৬টি বড় বড় দীঘি ছাড়াও বহু পুকুর খনন করিয়েছিলেন। সেসবের চিহ্ন আজও আছে। তবে প্রবাদ, তার আমলে ৩৬০টি মসজিদ ও ৩৬০টি দীঘি খনন করা হয়েছিল। জনকল্যাণে রাজপথ নির্মাণে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে বিরল। যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে খান জাহান আলী যে ইসলামী রাজ্য খলিফাতাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি তা শাসন করেছিলেন। খান জাহান আলী ৮৬৩ হিজরির ২৬ জিলহজ, ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার কবর গাত্রে এই তারিক লিপিবদ্ধ আছে। মৃত্যুও পর তারই নির্মিত সৌধে তাকে সমাহিত করা হয়। তার মাজারে প্রতিদিন অগণিত দর্শক ও ভক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করে। খান জাহান আলীর জীবনগাথা রূপকথার মতোই বিস্ময়কর। তার অমরকীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ। প্রতিদিন দেশ-বিদশের অগনিত দর্শকের ভিড়ে মুখরিত থাকে এর প্রাঙ্গণ আর সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এর নির্মাণকর্তাকে। সুন্দরবন অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে অছে খান জাহান আলীর অসংখ্য কীর্তিরাজি, যা আজও বহন করছে হারিয়ে খাওয়া সোনালি দিনগুলোর কথা। Email : [email protected]
×