ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার বর্জ্য নিয়ে টানাটানি ॥ পুড়িয়ে সার বানাতে চায় স্থানীয় সরকার, বিদ্যুতে আগ্রহী বিদ্যুত বিভাগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

এবার বর্জ্য নিয়ে টানাটানি ॥ পুড়িয়ে সার বানাতে চায় স্থানীয় সরকার, বিদ্যুতে আগ্রহী বিদ্যুত বিভাগ

রশিদ মামুন ॥ শহরে প্রতিদিনের সৃষ্ট বর্জ্য নিয়ে এবার টানাটানি শুরু হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য চুক্তি হয়। বেশ কয়েক বছর বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প নিয়ে দৌড়ঝাঁপ চলে। এখন বলা হচ্ছে বর্জ্য চুল্লিতে পুড়িয়ে ছাই উৎপাদন করা হবে। এ ছাই সার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এজন্য প্রকল্প গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১৭ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক স্বাক্ষরিত সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ভস্মীকরণ বিষয়ক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ঢাকার সিটি কর্পোরেশন অবিলম্বে ৫০০ থেকে এক হাজার টন বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্প গ্রহণ করবে। অন্যদিকে এখনও বিদ্যুত বিভাগ মনে করছে, মেয়ররা তাদের বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পের সঙ্গেই থাকবেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তারা মেয়রদের সঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমরা অনেকদিন থেকেই বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের চেষ্টা করছি। এখন আমরা মেয়রদের বলেছি আপনারা বিদ্যুত উৎপাদন করুন। পিডিবি এ বিদ্যুত কিনে নেবে। পৃথিবীতে এটি একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি ওয়েস্ট ও এনার্জি। বিদ্যুত বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ বর্জ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। সঙ্গত কারণে ঢাকার বর্জ্যে প্রকৃতপক্ষে কী হবে- পুড়িয়ে ছাইয়ের সার, না বিদ্যুত। চলছে জোর আলোচনা। ঢাকার দুই নগর অফিসের হিসাব বলছে, দেড় কোটির বেশি মানুষের এ ঢাকাতেই প্রতিদিন অন্তত আট হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে আরও এক হাজার ৫০০ টন বর্জ্য যোগ হয়। উৎপাদিত বর্জ্যরে মধ্যে আছে প্লাস্টিক, কাগজ, কাঁচ, ধাতু ও জৈব বর্জ্য। অন্যদিকে ঢাকার পরেই একই এলাকায় বেশিসংখ্যক মানুষের বাস চট্টগ্রামে। বন্দরনগরীতে একসঙ্গে বসবাস করছেন ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ। এখানে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য। কেবল এ দুই মহানগরীতে প্রায় ১২ হাজার টন বর্জ্যরে মধ্যে বেশিরভাই রান্নার উচ্ছিষ্ট পচনশীল, যা মিথেন উৎপাদন করতে সক্ষম। হিসাব বলছে, এ বর্জ্যরে পরিমাণ মোট বর্জ্যরে ৬০ শতাংশ। প্রতি এক মেগাওয়াট বিদ্যুত প্ল্যান্ট চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ৪০ টন বর্জ্য। এ হিসাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বর্জ্য দিয়ে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। এর বাইরে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরের বর্জ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। বর্জ্য ফেলার জন্য যেসব ল্যান্ডিং স্টেশন রয়েছে সেখানেই বিপুল জমি রয়েছে। ফলে নতুন করে জমিরও দরকার নেই। এখানেই বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা সম্ভব। সূত্র বলছে, ইতালিয়ান কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের সঙ্গে ২০১৩ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চুক্তি হয়। ঢাকার বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করার কথা ছিল কোম্পানিটির। পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনাও ছিল। সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে তিনটি মডেল অনুসরণ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করার বিষয়ে সিটি মেয়রদের প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রথমটিতে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে বিদ্যুত বিভাগ একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন করবে। এ কোম্পানি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। কিন্তু এখানে সিটি কর্পোরেশন মূলধন বিনিয়োগ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে। দ্বিতীয়টিতে সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য সরবরাহ নিয়মিত রাখবে- এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে পিডিবি কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করবে। দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা আইপিপি মডেল অনুসরণ করে কেন্দ্র নির্মাণ করবে। তৃতীয়টি হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নিজেই কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে পারে। কিন্তু এর কোন মডেলের সঙ্গে একমত হননি মেয়ররা। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, ২০১৪ সালের ১০ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে সিটি কর্পোরেশনগুলোর সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদন এবং বিতরণকারী কোম্পানির পৃথক কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সিটি মেয়ররা এ উদ্যোগকে পাশ কাটিয়ে নিজেরা বিদ্যুত কেন্দ্র করার ওপর জোর দেন। এ বিষয়ে গত বছরের ৭ ও ২৮ জুলাই দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বিদ্যুত বিভাগের পরিবর্তে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বিদ্যুত বিভাগকে এবং গত ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করা হয়। এরমধ্যেই স্থানীয় সরকার বিভাগকে নতুন উদ্যোগ নিতে দেখা গেল। গত ১৫ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত সভায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ঢাকার দুটি ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর সিটি এলাকার বর্জ্য পুড়িয়ে সার উৎপাদনের ওপর একটি সম্ভাব্যতা জরিপ তুলে ধরেন। সভায় জানানো হয়, মেয়র বিষয়টি আরও ভালভাবে দেখার জন্য চীন সফর করবেন। এর আগে অবশ্য একনেক সভায় গত ১ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে বর্জ্য পুড়িয়ে সার উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
×