ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিগারেটে টান দিয়ে এক টোকাই বলল কাজের সময় নেশা না করলে এনার্জি পাই না

রাত অইলে গাঁজা খাই, এ্যামনে ভ্যান্ডি... ওরা ভাঙ্গারি কুড়োয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

রাত অইলে গাঁজা খাই, এ্যামনে ভ্যান্ডি... ওরা ভাঙ্গারি কুড়োয়

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে রয়েছে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পাশ দিয়ে রাখা ময়লা-আবর্জনা টানার গাড়ির সারি। সেই সারির পাশ দিয়ে দশ কী বারো বছরের একটি শিশু আবর্জনাভর্তি গাড়ি টেনে নিয়ে এলো। সে এতই ছোট যে, সিটে বসে গাড়ির প্যাডেল ছুঁতে পারে না। কয়েক গজ সামনে গেলেই চোখে পড়বে একটি ভাঙ্গাড়ির দোকান। ওই দোকানে আবর্জনা কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকের কৌটা, কনডেনসড মিল্কের পরিত্যক্ত কৌটাসহ ছোট ছোট নষ্ট পণ্য বিক্রি করে আল-আমিন, ফারুক, লিমন, সাব্বিররা। সবার বয়স ১২ হতে ১৮ বছরের মধ্যে। অবহেলা, অযতেœ প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে অপুষ্টির শিকার হয়ে বড় হচ্ছে এসব শিশু। অক্ষরজ্ঞান ডিঙ্গিয়ে এ বয়সেই সংসারের হাল ধরতে ব্যস্ত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেই চোখে পড়ে এমন ভাঙ্গাড়ির দোকান। শিশুরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব পরিত্যক্ত বস্তু সংগ্রহ করে বিক্রি করে এখানে। এসব জড়ো করা ভাঙ্গাড়ি বেচাকেনার একটি বড় অংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। তারা কেউ স্কুলেও যায় না। অথচ এটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুম্রমের অন্তর্ভুক্ত। দেশে শিশুশ্রম নিরসনে সরকারী, বেসরকারী পর্যায়ে নানা উদ্যোগ এবং জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। রাজধানীর ধলপুর ভাঙ্গাড়ির দোকানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। ৫২টিরও বেশি আড়ত রয়েছে ধলপুরে। ময়লার স্তূপ থেকে লোহা, কাগজ ও প্লাস্টিক সংগ্রহ করে এসব আড়তে সরবরাহ করে প্রায় ৪৫০ শিশু। শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতায়ও বিরতি নেই এসব শিশুর। এছাড়া এ নোংরা পরিবেশে ক্রমান¦য়ে বেড়ে উঠতে থাকা এসব বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশ আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকাসক্তিতে। সঙ্গে ছিনতাইসহ নানা প্রকার অসামাজিক কর্মকা-েও জড়িত হচ্ছে তারা। ভাঙ্গাড়ি কুড়ানো দলের এক সদস্য তামিমের বয়স ১৫ বছর। ধলপুরের এক ভাঙ্গাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট খাচ্ছে। কেন সিগারেট খাচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে সে বলে, ‘কাজের সময় নেশা না করলে কাজে এনার্জি পাই না।’ সে অন্য কোন নেশা করে? তামিম বলল, ‘রাত অইলে গাঁজা খাই, এ্যামনে ড্যান্ডিও খাই।’ দিনে ৩০০ টাকা রোজগার করলেও তার অর্ধেকই ফুরিয়ে যায় তার নেশায়। কথাগুলো বলে নিশ্চিন্তে আবারও সিগারেটে টান দিল সে। শুধু তামিম নয়, রাজধানীর এসব টোকাই শ্রেণীর বেশিরভাগ পথশিশুই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সঙ্গে নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে তারা। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে দেশে শিশু ও কিশোর মাদকসেবীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। এদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই হলো পথশিশু। পায়ের বেশ বড় দুটি ক্ষত দেখিয়ে আসলাম বলল, ময়লার মধ্যে হাড় কুড়ানোর সময় কেটে গেলে এ ক্ষত হয়। কাজ বন্ধ করতে পারে না বলে এ ক্ষতেই বারবার আঘাত পায়, ফলে ঘা আর শুকায় না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আব্বাস জানায়, বাবা নেই, মা মাইনসের বাড়িতে কাজ করে। সেই টাকায় সংসার চলে না বলে তাকে কাজ করতে হয়। কেন অন্য কাজ না করে এ কাজ করÑ প্রশ্ন করলে তারা জানায়, তার বন্ধুরা সবাই একাজ করে। ‘সংসারই চলে না পড়মু ক্যামনে’ বলে জানায় আসলাম ও আব্বাস নামের ১৩ বছরের এ দুই কিশোর। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, দেশে ১৮ লাখ শিশু শ্রমিক আছে, যাদের মধ্যে ১৩ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে জড়িত। আইএলও কনভেনশন নং-১৮২ অনুস্বাক্ষরের অংশ হিসেবে শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮ কাজের তালিকা করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে আছে ভাঙ্গাড়ি কুড়ানোর কাজ। শিশু আইন ২০১৩, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০, গৃহ শ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৪- গত ছয় বছরে এ পাঁচটি নীতি হয়েছে। এছাড়া রয়েছে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১২ ও ’১৬। তারপরও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাজ করছে এমন কত শিশু তার হিসাব নেই। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনে বলা আছে, ছয় থেকে দশ বছরের শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত না করলে কোন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী অভিভাবকের ২০০ টাকা জরিমানা করা হবে। তবে এ জরিমানা কে দেবে বা কে নেবে তা কারও জানা নেই। এতে স্পষ্ট হয় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা। আর এজন্যই শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে আসলাম ও আব্বাসরা। যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে জীবিকার সন্ধানে বস্তা হাতে নিয়ে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভাঙ্গাড়ি পণ্য। শ্রম আইন ২০১৩-১৪ সালের নীতিতে শিশুকে কাজে নিয়োগ দেয়া এবং ১৮ বছরের নিচে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বাস্তবায়নে সরকারের গতি মন্থর। সঙ্গে আইন বাস্তবায়ন ও প্রচারের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের কর্মপরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
×