ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ ওয়াহিদুল হক

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ ওয়াহিদুল হক

‘অভয় বাজে হৃদয় মাঝে’ এই শিরোনামে জনকণ্ঠে লিখতেন তিনি। কখন? যখন সংস্কৃতি এক সময় আমাদের পথ দেখাত। রাজনীতি ছিল অনুগামী। এখন তার উল্টোটা ঘটছে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও দেশে সংস্কৃতির এত দৈন্য আগে চোখে পড়ত না। খেয়াল করবেন মানুষ রাজনীতিকে বাই বাই করে দিয়েছে অনেক আগে। তারা দেশ ও জাতির মঙ্গল চায়, নিজেরা ভাল থাকতে চায়। এর বাইরে তাদের কোন বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। অথচ আমাদের মিডিয়াজুড়ে দিন-রাত সেই মানুষগুলোর মুখ। এটা একটা খেলার মতো। একবার যারা কোনভাবে ট্র্যাকে আছে তারা আর কাউকে ঢুকতে দেয় না। অথচ আমরা এমন দেশ এমন জাতির মানুষ যেখানে রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের সময় ও সংস্কৃতির বাইরে পা ফেলতে পারেনি। তখন আমরা ছোট হলেও স্পষ্ট মনে আছে সেøাগান উঠত, তুমি কে আমি কে? বাঙালী বাঙালী। আজ সেই পরিচয় প্রায় সেকেন্ডারি হয়ে গেছে। আগে ধর্মীয় পরিচয়, তারপর জাতিসত্তা। তখন আমরা বলতাম তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। এখন বলি আমরা হব তালেবান। তখন শাড়ি, পাঞ্জাবি-পায়জামার প্রতি ঝোঁক। এখন বিদেশী পোশাকে দিওয়ানা আমরা। সংস্কৃতির এতই আকাল কোথাও সে ভাল করে দানা বাঁধতে পারছে না। তার চোখের সামনে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যত, হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। তবু আমাদের সংস্কৃতির ধারকরা জাগছেন না অথবা জেগেও ঘুমিয়ে আছেন। আজ যখন এসব দুঃখের কথা লিখছি তখন এমন একজন মানুষকে মনে পড়ছে যিনি মনেপ্রাণে, ধ্যানেজ্ঞানে ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালী। আমাদের যৌবনের শুরুতে ফুলকিতে তার সঙ্গে পরিচয়। তখন আমাদের কাউকে না মানার বয়স। কথায় কথায় অন্যদের চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য মরিয়া আমরা। দেখতে মোটেই আকর্ষণীয় ছিলেন না। বরং তার উল্টো স্বাভাবিক বাঙালীর চেয়ে খাটো পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামায় তাঁকে কেমন যেন দেখাত। কিন্তু একবার তাঁর সঙ্গে কথা বললে বা পরিচিত হলে তাঁকে এড়ানোর সাধ্য ছিল না কারও। আমাদের নিয়মিত সাহিত্য আড্ডায় তিনি যোগ দিতেন মাঝে মাঝে। এমন সব নতুন বিষয়ে কথা বলতেন চমকে যেতাম। তাঁকে কবিতা শোনানোও ছিল বিরল অভিজ্ঞতা। আমাদের পাঠচক্রে সুভাষিত নামে এক ধরনের কবিতা লেখার উৎসাহ যুগিয়েছিলেন তিনি, যা অনেকটাই উর্দু শেরের মতো। আমাদের বন্ধুরা সবাই চেষ্টা করলেও তিনি জ্যোতির্ময় নন্দী ও শাহিদ আনোয়ারেরগুলো ছাড়া আর কারও কবিতাকে সুভাষিত বলে ছাড় দেননি। তাঁর অগাধ পা-িত্যের একটা উদাহরণ দেই। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রণজিৎ বিশ্বাস ছিলেন লাইব্রেরিপ্রাণ মানুষ। তরুণ বয়স থেকে তিনি পড়াশোনায় মজে থাকতেন। বাংলা ব্যাকরণ আর বিষয়ের গভীরতায় তাঁর তুলনা মেলা ভার। একবার তিনি তিমি মাছের ওপর একটি ঢাউস লেখা নিয়ে এসেছিলেন অচিরা পাঠচক্রে। তাঁর সেই লেখা পাঠের পর আমরা তো পাঠমুগ্ধ। সবশেষে মুখ খুললেন ওয়াহিদ ভাই। তিমি কি, তিমি কত প্রকার ও কাহাকে বলে এ বিষয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা বলেছিলেন তিনি। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পর রণজিৎ দা গবেষণালব্ধ লেখাটি আবারও চোখ বুলিয়ে তারপর ছাপতে দিয়েছিলেন। এটা তো আমাদের যৌবনের শুরুর ঘটনা। পরে তিনি যখন ঢাকায় চলে গেলেন তখন আরও অনেক ঘটনার কথা জানি। সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও বিস্তৃতি দেখার। ওয়াহিদুল হক যে আসলে কী বা কে ছিলেন এ বিষয়ে আমাদের বিদায়ী গবর্নর আতিউর রহমানের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। ওয়াহিদ ভাই তখন হাসপাতালে। রোগশয্যায় তাঁকে দেখার জন্য মানুষের স্রোত নেমেছিল। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু“করে ববস্ক সব মানুষের ভিড়। আতিউর রহমানের স্ত্রী পেশায় চিকিৎসক। ওয়াহিদ ভাইয়ের ছাত্রী। তাঁরও চোখে জল। সব দেখেশুনে সেবিকার বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ে না। একদিন সে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা কে এই ওয়াহিদুল হক আসলে? কঠিন প্রশ্ন বটে! খুব সহজ করে উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের ভূতপূর্ব গবর্নর। এক কথায় বলেছিলেন, কে নন? আসলেই ‘কে নন’ তিনি? যখন মর্নিং নিউজে কাজ করতেন ইত্তেফাকে এসেছিল কয়েকজন বিদেশী। যাঁরা মূলত কৃষ্ণভাবনা ও আদর্শের অনুসারী। তাঁরা এসেছিলেন চৈতন্য জন্মভূমি শ্রীহট্ট যাবেন বলে। যাবার আগে আর একটু জানার জন্য ঢাকার ইত্তেফাক ভবনে আসা এই অতিথিদের সঙ্গে কথা বলার ভার পড়েছিল ওয়াহিদুল হকের ওপর। নজরুল বিশেষজ্ঞ করুণাময় গোস্বামী লিখেছেন, এদের সামনে বসে ওয়াহিদুল হক শুরু করেছিলেন চৈতন্যবিষয়ক তাঁর অভিমত। শুনতে শুনতে মুগ্ধ বিদেশীরা মাটিতে বসে পড়েছিলেন। ভক্তিরসে আপ্লুত তাঁরা ঝোলানো থলে থেকে বের করে এনেছিলেন তিলক সরঞ্জাম। ওয়াহিদ ভাইয়ের কপালে তিলক এঁকে প্রণাম জানিয়ে তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, তিনি শ্রী চৈতন্যের বংশধর কিনা। এমন ক্যারিশমা, এমন জানাশোনা বাঙালী আজ বিরল। ঢাকার এক প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য চোখের ডাক্তারের দর্শনপ্রার্থী হয়েছিলেন ওয়াহিদুল হক। ব্যস্ত ডাক্তার কিছুতেই সময় দিতে পারছিলেন না। যখন শেষ অবধি সময় দিয়েছিলেন তখন কী হয়েছিল সেটাই আসলে ইতিহাস। তিনি যে চেম্বারে ঢুকলেন আর বেরুচ্ছেন না। ডাক্তার তাঁকে ছাড়তে নারাজ। চোখের অসুখ তিনি বাতলে দিয়ে ওষুধ দিয়েছিলেন বটে! কিন্তু চোখ আসলে কি এবং চোখের কত নাম, চোখের কী রং, কেন চোখ কথা বলে, এসব বিষয়ে কিছুই জানতেন না ডাক্তার। ওয়াহিদ ভাইকে তিনি দুটো চোখের ওষুধ দিলেও ওয়াহিদ ভাই খুলে দিয়েছিলেন ডাক্তারের সহস্র চোখের পাতা। সেই থেকে ওই ডাক্তার ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম ভক্ত। এমন ভক্ত ছিল সব পেশায়। তারপরও এটাই তাঁর আসল পরিচয় নয়। মূলত তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসাধক। সাধক শব্দটা এখন পুরনো। কেউ তা হতেও চায় না। এই মানুষটি গ্রামেগঞ্জে ঘুরে রবীন্দ্রনাথকে জনপ্রিয় করার কঠিন কাজটি মাথায় নিয়েছিলেন। দেশের আনাচে-কানাচে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসার সম্মেলনের এমন ভাবনা কারও মাথায় আসেনি আগে। বাংলাদেশে আজ যারা মৌলবাদীদের ভয়ে ঘরকুনো, যারা সুশীল নামে পরিচিত তারা ভাবতেও পারবেন না ওয়াহিদ ভাই কীভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার ব্রত নিয়েছিলেন। দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন, সময় নেই অসময় নেই একদল ছেলেপিলে নিয়ে হাজির হতেন তিনি। এসেই হাঁক পাড়তেন যা আছে তা দিয়ে ভাত দাও আমাদের। করুণাময় গোস্বামী লিখেছেন এ নিয়ে। চাটগাঁর অনেক গুণীজনও জানেন এ বিষয়ে। তাদের বিব্রত হওয়া না হওয়াকে মনে নিতেন না তিনি। কেউ তাঁকে ছোট ভাবল কিনা তা নিয়েও মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। গৃহকর্তাকে জোর করে অতিথিপ্রবণ করে তুলে রবীন্দ্রনাথের প্রিয়তা বাড়ানোর মানুষ আজ আর একজনও পাবেন না কোথাও। পাবেন কাউকে যিনি নিজের জমি বন্ধক রেখে শৈলজারঞ্জনকে নিয়ে আসবেন বাংলাদেশে? আজকের বাণিজ্যিক যুগে এমন মানুষ নেই। ২৭ জানুয়ারি লেখক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ, বাঙালী জাতির অসাম্প্রদায়িকতার দূত ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুদিন। সব ছাপিয়ে এমন মনেপ্রাণে বাঙালী এখন আর দেখি না। দেখি না স্বল্প উচ্চতার একটি মানুষের অপার আলোর দ্যুতি। চিরপ্রণম্য ওয়াহিদুল হককে জানাই বাংলাদেশের ভালবাসা। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আমাদের পথ দেখাবেন। আমাদের অন্ধকার আকাশে শুকতারা হয়ে জ্বলবেন, যেন আমরা পথ না হারাই। তাঁর প্রিয় একটি গানের কথা দিয়ে শেষ করি- বিধির বিধান কাটবে তুমি এমন শক্তিমান/তুমি কি এমনি শক্তিমান? এ কথা জানতেন তিনি, বিশ্বাসও করতেন, তাই বাঙালী হয়ে জন্মেছিলেন, বাঙালী হয়েই শেষ বিদায় নিয়েছিলেন।
×