ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

ভাতের জন্য বৃদ্ধরা চুরি করে, নির্মল বায়ুর অভাবে মানুষ মরে

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

ভাতের জন্য বৃদ্ধরা চুরি করে, নির্মল বায়ুর অভাবে মানুষ মরে

আজকে প্রথমেই বলব জাপানের কথা, তারপর চীনের। প্রথম দেশটি পুরনো ধনী দেশ, দ্বিতীয়টি নব্য ধনী দেশ। উভয়ই অবশ্য প্রাচ্য সভ্যতার দেশ। উভয়ই উন্নতির, উন্নয়নের শীর্ষ পর্যায়ের দেশ। সেখানকার উন্নয়নের বর্তমান অবস্থা কী? গত কয়েকদিন আগের একটি খবর, হয়ত অনেকেরই নজরে এসেছে অথবা আসেনি। খবরটি দিয়েছে বিখ্যাত সংবাদ এজেন্সি ‘এএফপি’। খবর দেয়া হয়েছে টোকিও শহর থেকে খবরে বলা হচ্ছে জাপানের জেলখানাগুলো বুড়ো কয়েদিতে ভরে যাচ্ছে। দিন দিনই এদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালে পুলিশ যত লোককে গ্রেফতার করেছে অথবা জেরা করার জন্য আটক করেছে তার ২০ শতাংশেরই বয়স ৬৫ বছরের বেশি। কেন বুড়োদের এই অবস্থা। তারা এখন ছোটখাটো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। যেমন ধরা যাক, দোকানের মাল চুরি করা। কেন? বুড়োরা মনে করেন জেলে যাওয়াই শ্রেয়। জেলখানা নিরাপদ, সেখানে খাবারের দুশ্চিন্তা নেই। চিকিৎসারও ব্যবস্থা আছে। বুড়োরা জেলখানায় আবার সব কাজেই নিয়মিত। তারা ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ঠিক সময়ে নাস্তা করে এবং যথাসময়ে কাজে যায়। বুড়োদের ভিড় জেলখানায় এমন বেড়েছে যে, জাপান সরকারকে এখন জেলখানায় নার্স নিয়োগ দিতে হচ্ছে। বুড়োরা জেল থেকে বাইরে যেতে চায় না। বাইরের জীবন বড়ই অনিশ্চিত। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ছাপ সর্বত্র। বুড়োদের এই চিত্রের কথা পড়তে পড়তেই মনে পড়ে গেল এক-দুই বছর আগের কথা। একটি কাগজে দেখেছিলাম এক প্রৌঢ়ের ছবি। তিনি রাস্তায় বসে খাচ্ছেন, কেউ তাকে দয়াপরবশ হয়ে খাবার দিয়ে গেছে। ভদ্রলোক ভিখারি নন। রীতিমতো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। কিন্তু বেকার কর্ম, নেই। সংশ্লিষ্ট খবরটিতে বলা হচ্ছে লোকের সংসার চলে না। কী ছেলে, কী মেয়ে একটি নয় দুই দুইটি চাকরি করেও দুই বেলা অন্ন জোটাতে পারে না। ছেলেমেয়েরা বিয়েশাদি করে না। ঘর-সংসারের নাম নেয় না। চল্লিশে পড়ে পড়ে তবুও বিয়েশাদির নাম নেয় না। ভয় সংসার চলবে কীভাবে? বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন আছে। কিন্তু বাতি জ্বলে কম, কারণ বিলের টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই। ফ্রিজ আছে, কিন্তু ফ্রিজ চলে না। গাড়ি আছে, গাড়ি চলে না, গ্যাসোলিনের টাকা কোথায়? এসব পড়তে পড়তে ‘সাসটেনেবল’ ডেভেলপমেন্টের কথা মনে পড়ে, যা আজকাল খুব বেশি আলোচনা হয়। হবেই তো। জাপান তো এমন ছিল না। কী রমরমা অবস্থা জাপানের। ধরুন ৫০-৬০ বছর আগের কথা। ঢাকাসহ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) সর্বত্র শুধু জাপানের মাল। জামা-কাপড় সব জাপানী। ট্রেটন, টেরিলিন ইত্যাদি ফকফকে সাদা কাপড় ও তাতে তৈরি জামা আজকের দিনের জিপিওর উল্টোদিকে যেখানে জাসদের অফিস তার নিচে ছিল ‘গেনিস’-এর বিশাল দোকান। এর প্রায় সব মালই জাপানে তৈরি। রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ, আয়রন, এসি, ছোটখাটো বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম সবই জাপানের তৈরি। জাপান, জাপান সর্বত্রই জাপান। ‘কোয়ালিটি’? নিখুঁত। শুধু কী বাংলাদেশে ছিল এই অবস্থা? না, পৃথিবীর সর্বত্র। সে কারণেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানের অর্থনৈতিক ইতিহাসে পড়তাম, যা ছিল পাঠ্যসূচীতে। ‘মেইজি রেস্টোরেশন’ দিয়ে শুরু করে খুব যতœসহকারে পড়াতেন ড. আবদুল্লাহ ফারুক। মনে হতো দুনিয়ার দেশ থাকলে একটিইÑ জাপান। পশ্চিমা মূল্যবোধের বিপরীতে প্রাচ্যরীতিতে উন্নতি করেছে জাপান। ‘সিনিয়রিটি’, ‘লাইফলং সার্ভিস’, ‘লয়ালিটি’ ইত্যাদি হচ্ছে চাকরি জীবনের বৈশিষ্ট্য। আজকের দিনে এসব ভাবলে মনে হয় কোথায় গেল জাপান? উঠে এসেছে চীন। ত্রিশ, চল্লিশ বছর আগে চীন ছিল ঘুমিয়ে। ঘুমিয়ে ভারত। আজ চীন যা ‘ড্রাগনের দেশ’ হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই চীন বিশ্বজয় করেছে। বাংলাদেশের বাজার চীনের দখলে। হাতঘড়ির বেল্ট থেকে সবকিছুই আজ চীনের তৈরি। চীন আজ আমাদের এক নম্বর ট্রেডিং পার্টনার। এক সময় ছিল জাপান। চীন বিশ্বকে জয় করেছে। আমেরিকা চীন চীন করতে দিশেহারা। বিশ্বের এক নম্বর ধনী দেশটি এখন সবচেয়ে বেশি ঋণী চীনের কাছে। চীন যেখানেই যায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের এমন শক্তি হয়েছে যে, তারা এখন জাতিসংঘের বিচার পর্যন্ত মানে না। ক্রমাগতভাবে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর যাবত চীন ১০-১৫ শতাংশ হারে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি করেছে। শিল্পায়নের জন্য জাপানের মতো ‘ব্যাংক লোন’-এর ওপর নির্ভর করেছে চীন। উন্নয়নের গতি ঠিক রাখার জন্য চীন ‘এক সন্তান’ নীতি অব্যাহতভাবে অনুসরণ করেছে। শ্রমকে সস্তা রাখার জন্য গ্রামের শ্রমিককে শহরে ঢুকতে দেয়নি। ফলে চুরি করে তারা শহরে এসে সস্তায় শ্রম দিয়েছে। আবার গ্রামেও দিয়েছে তারা সস্তা শ্রম। ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ‘শেডো ব্যাংকিং’ও ছিল প্রবল। চীন বাড়তে দিয়েছে বৈষম্য, আয় বৈষম্য। সরকারীভাবে তারা বলছে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির’ দেশ তারা। কিন্তু কিছু লোককে টাকা বানাতে দিয়েছে। বিশ্বাস তারাই করবে উন্নয়নের কাজ। হয়েছেও তাই। তাই খবরের শিরোনাম : ‘বেজিং’: যে শহরে ধনী ও দরিদ্রের জন্য পৃথক বাতাস। এই তো সেদিনের খবর এটি। বাতাস মানে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নির্মল বায়ু। বেজিং শহরে এখন নির্মল বায়ু নেই। বাঁচার ব্যবস্থা নেই গরিব ও মধ্যবিত্তের। বাঁচছে শুধু ধনীরা, অঢেল ধনের মালিক যারা। শহরে যারা মারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে ৩২ শতাংশ মানুষই মারা যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে, বায়ু দূষণের কারণে। সারা চীনের হিসাবে ওই দেশে যত লোক মারা যায় তার এক-তৃতীয়াংশ মারা যায় কল-কারখানার ধোঁয়া ও সৃষ্ট কুয়াশার কারণে। এমতাবস্থায় ধনীরা নির্মল বাতাস যোগাড় করে প্রচুর টাকা খরচ করে। তাদের দুই বাড়িÑ শহরে একটি, আর উপকণ্ঠে বাগানবাড়ি। বাকিরা মরে, মরে কারণ তাদের কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফিল্টার করার যন্ত্র নেই, মানে যন্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। ওপরের দুটো উদাহরণ কেন দিলাম? দিলাম বোঝার জন্য। ‘উন্নয়ন’ মানে নিরঙ্কুশ স্বাচ্ছন্দ্য নয়, যদি না অগ্রিম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ‘উন্নয়নের’ ভেতরেই লুক্কায়িত ‘মরণবীজ’। উদাহরণ দেয়া যাক। লোক বেকার। কৃষিতে লোকের কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে না। অতএব দরকার শিল্পায়ন। শিল্পায়ন শুরু হলো। লোকের কর্মসংস্থান হতে লাগল। কিন্তু কথা উঠল প্রতিযোগিতার। বিশ্বায়ন থেকে এই কথা! প্রতিযোগিতা করতে হলে মজুরি (ওয়েজেস) কম রাখতে হবে। অথচ শ্রমিক চায় ন্যায্য মজুরি। মালিক বলছেন উচ্চ মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। আর ওই ব্যয়ে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা করা যাবে না। যারা কম মজুরি দেয় তারাই বিশ্ব দখল করে। অর্থাৎ শ্রমিক (শ্রম) এবং মালিকের (ক্যাপিটেল) দ্বন্দ্ব হলো শুরু। সস্তা শ্রমের জন্য বড় বড় কর্পোরেশন, কোম্পানি নিজ দেশ ছেড়ে দিল। চলে গেল বিদেশে (আউট সোর্সিং)। নিজ দেশের লোককে চাকরিচ্যুত করল। কারণ তারা বেশি মজুরি চায়। শ্রমিক এলো বাইরে থেকে (সস্তা শ্রম)। অভিবাসন সামনে এলো। এতেও হয় না। মানুষই মূল সমস্যা। মানুষরূপী শ্রমিকরা সুযোগ-সুবিধা চায়, বেশি মজুরি চায়, আরাম-আয়েশ চায়। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। কী করা দরকার? আসল ‘রোবট’। মানুষের কাজ করবে যন্ত্র। বেশি বেশি যন্ত্র। যন্ত্রের সঙ্গে গোল বেধেছে এখন মানুষের। মানুষের চাকরি যায়। গ্রামাঞ্চলে আমাদের শুরু হয়েছে সাবেক সমস্যা। শ্রমের মূল্য বেশি। যন্ত্র চালু হচ্ছে। শ্রমিক আসছে শহরে। শহর মানুষে ভরে যাচ্ছে। শহর হচ্ছে অবাসযোগ্য। এদিকে সারাবিশ্বেই সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশের সমস্যা। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে সর্বত্র। ঢাকার কথাই ধরা যাক। ঢাকার আশপাশে শিল্প হয়েছে/হচ্ছে। প্রচুর কারখানা। বিপরীতে ঢাকার চারপাশের নদী সব শেষ। বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার জলে এখন হাত দেয়া যায় না, এদের জল খাওয়া তো দূরের কথা। ঢাকার লোককে পানীয় জল খাওয়াতে হবে অন্য জায়গা থেকে এনে। আসবে হয়ত যমুনা নদী থেকে। উন্নয়নের পাশাপাশি কিন্তু এসব ঘটে যাচ্ছে। এটা আমাদের একক সমস্যা নয়। সারাবিশ্বের দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। বিশ্ব হয়ে উঠছে অস্থির। যে আমেরিকা অবাধ পুঁজিবাদে বিশ্বাসী বলে আমরা জানতাম, যে আমেরিকাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উদার বাণিজ্যের পক্ষে বলে আমরা জানতাম তারা এখন বলছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। আমেরিকানদের চাকরি প্রথমে। কারখানা দেশে করতে হবে। সস্তা শ্রমের জন্য বাইরে গেলে ‘ট্যাক্স বসবে’। তাহলে কী দাঁড়াল? ‘শ্রম ও ক্যাপিটেলের’ দ্বন্দ্ব প্রকট। এর সমাধান কী? সমাধান দরকার হবে। তা দরকার হবে সব দেশেই। বাংলাদেশেও। শত হোক উন্নয়ন মানুষকে কর্মহীন করে ফেলবে, বেকার করে ফেলবে, অসহায় করে ফেলবে তা হবে না। উন্নয়ন করতে করতে জাপানের মতো দশা হবে তা কারও কাম্য নয়। উন্নয়ন করতে করতে শ্বাসকষ্টে মারা যাবে অগুনতি লোক, আর কিছু লোক বাগানবাড়িতে থাকবে এবং অফিস করবে বহু টাকা খরচ করে ‘মাস্ক’ পরে তা হবে না। অর্থনৈতিক বৈষম্য চলবে না। ৩৬০ কোটি লোকের সম্পদের সমান সম্পদ হবে ৮ জনের সম্পদ তা কীভাবে মানা যায় যখন বৃদ্ধদের দুটো অন্নের জন্য জেলবাস করতে হয়। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাবি
×