ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাঁড়াও... জন্ম যদি তব বঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

দাঁড়াও... জন্ম যদি তব বঙ্গে

বাংলার মহাকাব্য ও চতুর্দশপদী কবিতার অমর স্রষ্টা এবং আধুনিক বাংলা নাটকের নতুন ধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের ধূমকেতু। জন্ম ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ যশোরের সাগরদাঁড়িতে। মৃত্যু কলকাতায় আলীপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২৯ জুন, ১৯৭৩। সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি জীবনের ৪৯ বছরের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে সুতীব্র মানসিক যন্ত্রণালয়। উৎপল দত্ত মাইকেলকে বাংলা সাহিত্যের ‘এক ট্রাজিক ও যন্ত্রণাদীর্ণ’ চরিত্র বলে উল্লেখ করেছেন। জন্মদিনে বাংলার এ মহান নাট্যকারকে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই। নাট্য রচনার মধ্য দিয়ে মাইকেলের সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের শুভ সূচনা। প্রাচীন রীতিনীতি ও মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা থেকে নাটককে মুক্ত করলেন এবং পাশ্চাত্য নাট্য আঙ্গিকে বাংলা নাট্য রচনার ধারা তৈরি করে এক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে রইলেন মাইকেল মধুসূদন। তাঁর রচিত নাটকের সংখ্যা ৭। এগুলো হচ্ছে- শর্মিষ্ঠা (১৯৫৯), পদ্মাবতী (১৮৬০), সুভদ্রা, রিজিয়া (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১), হেক্টর বধ, মায়াকানন (১৮৭৪)। বাঙালী প্রাণে মাইকেলের স্মৃতি অম্লান। তাঁর ‘যন্ত্রণাদীর্ণ’ জীবনের সঙ্গে বাংলার মানুষও সমব্যথী। তাঁর সৃষ্টি বৈচিত্র্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ বাঙালীর। সুর করে ‘মেঘনাদ বধ’ পড়ে। কিন্তু নাটক মঞ্চায়নে সাহস পায় না। কঠিন শব্দ অলঙ্কারে ঠাসা সংলাপ, কোথাও কোথাও ঘটনা ও চরিত্রের চাইতে বর্ণনাত্মক রীতির প্রবণতা, কাহিনীর বিষয়বস্তু হচ্ছে পৌরাণিক কিংবা ঐতিহাসিক আখ্যান- এসব কারণে সেকালে ও একালে মাইকেল নাট্যভিনয়ের ধারা তেমন বেগবান নয়। মঞ্চাভিনয়ের চাইতে কলেজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের সিলেবাসে মাইকেলের নাটক অধিক পাঠ্য। মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রথম মঞ্চে আসে ১৮৫৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। বেলগাছিয়া নাট্যশালার উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি মঞ্চস্থ হয়। ১৫৮ বছর আগে অভিনীত শর্মিষ্ঠা নাট্যাভিনয়ের একটি শিল্পীতালিকা এ রকম: রাজা যযাতি-প্রিয়নাথ দত্ত, মাধ্যব্য-কেশব চন্দ্র গাঙ্গুলী, শুক্রাচার্য-দীননাথ ঘোষ।কপিল-শরৎচন্দ্র ঘোষ, বকাসুর-ঈশ্বর চন্দ্র সিংহ, দৈত্য-তারাচাঁদ গুহ। তখন অভিনয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। শর্মিষ্ঠার ৪টি স্ত্রী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করেন। শর্মিষ্ঠা-কৃষ্ঠধন ব্যানার্জী, দেবযানা-হেমচন্দ্র মুখার্জী, পূর্ণিমা-কল্যদাস, দেবিকা-অঘোরচন্দ্র। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার কিছু আগে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের বাগবাজার এ্যামেচার থিয়েটার পার্টিতে শর্মিষ্ঠা যাত্রাপালা হিসাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল। পরের বছর ১৬ অক্টোবর বেঙ্গলী থিয়েটারে অভিনীত হয়। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে কোন নাট্যদলে এই ক্লাসিক নাটকের মঞ্চায়ন হয়নি। ২০০৭ সালে থিয়েটার স্কুলের তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের সমাপনী প্রযোজনা হিসেবে শর্মিষ্ঠা মঞ্চস্থ করে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বাংলাদেশে ‘মাইকেল’র নাট্য মঞ্চায়ন তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কালেভাদ্রে দু’একটি প্রযোজনা চোখে পড়ে। এ ক্ষেত্রে প্রথম নিদর্শন ১৯৭২ সালে আতাউর রহমানের নির্দেশনায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে শিক্ষকদের প্রযোজনায় মঞ্চে এসেছে ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের নাট্য রূপান্তর। শেষের দুরূহ কাজটি করেছেন অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন। মাইকেল মধুসূদনের জীবন-চরিত নিয়ে লেখা হয়েছে একাধিক নাটক ও যাত্রাপালা। এগুলো হচ্ছে: বনফুলের শ্রীমধুসূদন (১৯৩৯), মহেন্দ্র গুপ্তের ‘মহাকবি মাইকেল’ (১৯৪২), নিতাই ভট্টাচার্যের ‘মাইকেল মধুসূধন’ (১৯৪৩), অজয় চক্রবর্তীর ‘মহাকবি’ (১৯৫২)। ১৯৯৩ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় মুহম্মদ শফির ‘মহাকবি মধুসূদন’। বিধায়ক ভট্টাচার্য রচনা করেন যাত্রাপালা ‘বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন’ ১৯৬৬ সালে। পশ্চিমবঙ্গে মধুসূদন চরিত্রে অভিনয় করেছেন- নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী, নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী এবং যাত্রানট স্বপন কুমার। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম মধুকবিকে নিয়ে রচিত যাত্রাপালায় অভিনয় করেন- নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস। এই ঐতিহাসিক ঘটনার ২০ বছর পর ১৯৯৩ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ মঞ্চে আসে। নির্দেশনা জামালউদ্দিন হোসেন। মধুসূদনের ভূমিকায় ছিলেন সালেক খান। কি আশ্চর্য অফুরন্ত সৃজনীশক্তি মাইকেলের! জীবনদীপ নির্বাপিত হওয়ার পরেও তাঁকে নিয়ে নাটক রচনার তুমুল প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় নতুন করে অর্থাৎ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ পাদে যুক্ত হলো আরেকটি নাটকীয় নাম ‘দাঁড়াও... জন্ম যদি তব বঙ্গে’। লিখেছেন অতিসাম্প্রতিক কালের এক তরুণ নাট্যকার অপূর্ব কুমার কু-ু। অনন্ত হীরার নির্দেশনায় নাটকটি আজ পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। মাইকেলের রূপসজ্জায় দর্শক দেখবেন স্বয়ং অনন্তকে। তার কণ্ঠে ভেসে আসবে মাইকেলের সেই অন্তিমকালীন এপিটাপ- ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল... এ মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’, যেমনটি উচ্চারণ করেছিলেন ৪৪ বছর আগে সাগরদাঁড়ির মধুমেলায় নটশ্রেষ্ঠ অমলেন্দু বিশ্বাস।
×