ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলিত এক জেদি বডিবিল্ডারের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

অবহেলিত এক জেদি বডিবিল্ডারের স্বপ্ন

রুমেল খান ॥ শরীর সুস্থ থাকলে মনও ভাল থাকে। শরীরটাকে ঠিক রাখার আদর্শ পন্থা হচ্ছে শরীর গঠন বা বডিবিল্ডিং। কিন্তু বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশন এমন কাজ করেছে, তাতে মন অসুস্থ হয়ে যেতে বাধ্য। ২৩ বছর বয়সী সুদর্শন বডিবিল্ডার হাসিব মোঃ হলি হয়েছেন বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের অবহেলা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের শিকার। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম হাসিবকে ব্যঙ্গ করে বলেন, আগামী ৪-৫ বছরেও বাংলাদেশের কোন বডিবিল্ডার কোন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কোন পদকই পাবে না। অন্য কেউ হলে এতে দমে যেত। রণে ভঙ্গ দিত। কিন্তু হাসিব যে কঠিন ধাতুতে গড়া। তিনি হাল ছাড়েননি। নজরুলের কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। তারপর ফেডারেশনের কোন সাহায্য না নিয়েই নিজ খরচে (১ লাখ ৩০ হাজার টাকা) একাই চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে ‘নাব্বা ওয়ার্ল্ড ফিটনেস ফেডারেশন এশিয়া মাসল ওয়ার’ বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় (১৫-১৭ জানুয়ারি, অংশ নেয় ১৩ দেশ) অংশ নিয়ে অনুর্ধ-২৪ জুনিয়র বিভাগে জিতে নেন স্বর্ণপদক। এই ধরনের টুর্নামেন্টে এর আগে কোন বাংলাদেশীই অংশ নেননি, কোন পদক পাওয়া তো দূরের কথা। সেখানেই অভিষেকেই বাজিমাত করেন হাসিব। স্বভাবতই এটি বাংলাদেশের বডিবিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সাফল্য এবং যুগান্তকারী ঘটনা। তবে ফেডারেশনের উদ্যোগে না যাওয়াতে হাসিবের এই অভাবনীয় সাফল্য পাদপ্রদীপের আলোয় সেভাবে আসছে না। ভবিষ্যত লক্ষ্য? হেরিয়ট ওয়াল ইউনি (ইউকে) বিবিএ (ডিসট্যান্স লার্নিং) শিক্ষার্থী হাসিবের ভাষ্য, ‘আমি দেশের সুনাম বাড়াতে চাই। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আগামী দুই বছরের মধ্যে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চাই। এজন্য প্রচুর প্রশিক্ষণ এবং অর্থ বা পৃষ্ঠপোষক দরকার। এ নিয়ে খুব চিন্তায় ও চাপে আছি। কেননা আমার পরবর্তী লক্ষ্য আগামী জুনে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়া। এতে প্রায় ৫০ দেশের প্রতিযোগী অংশ নেবে।’ ফেডারেশনের এই বিমাতাসুলভ আচরণের পেছনের গল্পটাও শোনান হাসিব, ২০১৬ সালের মে। আমি চীনে যাই ‘আইএফবিবি মিস্টার এশিয়া’তে অংশ নিতে। নিয়ম অনুযায়ী এজন্য আমাকে ফেডারেশনের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন নেয়ার সময় তারা আমাকে অবাক করে দিয়ে জানান, তারা আমাকে চীনে যেতে অনুমোদন দেবেন এক শর্তে। তা হলো চীনে যাওয়ার কোন খরচ তারা আমাকে দেবেন না এবং আমি কোন পদক জিতলে তার পুরো কৃতিত্ব তাদের দিতে হবে। যেমন তারা মিডিয়াতে প্রচার করবেন তারাই আমাকে চীনে যাওয়ার খরচ দিয়েছেন, আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ইত্যাদি। তাদের এমন হীন মানসিকতা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ি। বাধ্য হয়ে তাদের শর্ত মেনে নেই। তখনই প্রতিজ্ঞা করি, এরপর থেকে বিদেশে খেললে ফেডারেশনের অনুমোদন নিতে হবে না, এ রকম টুর্নামেন্টেই খেলব এবং নিজের খরচেই খেলব। তারই ফল কদিন আগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে গোল্ড মেডেল জিতে আসা। আসলে ফেডারেশনের এমন মনোভাব সত্যিই দুঃখজনক।’ চীনে এবং সিঙ্গাপুরে গিয়েও বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে ২০১৫ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে স্বর্ণজয়ী (মিস্টার বাংলাদেশ) হাসিবকে। কোন বডিবিল্ডারই বাংলাদেশ নামের কোন দেশকে চেনে না। এজন্যও আমাকে অনেকেই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেছে। ‘অনেকেই বলেছে এটা কি ভারতের কোন প্রদেশ নাকি? বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তাদের বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সবার এই অজ্ঞতা-অবহেলা দেখে মনে অনেক জেদের জন্ম হয়। পণ করি পদক জিতে সবাইকে বুঝিয়ে দেব বাংলাদেশ কি এবং কোথায়।’ স্বর্ণ জেতার পর অনুভূতির কথাও জানান বাংলাদেশের প্রথম সার্টিফাইট ট্রেনার হাসিব, ‘পুরো বিষয়টা ছিল এ্যাডভেঞ্চারের মতো। একটা দেশে গেছি প্রথমবারের মতো, তাও একা। স্বর্ণ জিতে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এটা ছিল জুয়া খেলার মতো। কেননা ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরলে ফেডারেশন আবারও আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করত। ওটা ছিল আমার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।’ ঢাকার নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের নিবাসী, ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এবং বাবা নিজামউদ্দিন ও মা সালমা আক্তার সীমার ছেলে হাসিব চীন এবং সিঙ্গাপুরে নিজ খরচে যেতে গিয়ে এখন ঋণের ভারে জর্জরিত। টুয়েন্টিফোর হাওয়ার ফিটনেস নামের একটা ফিটনেস ট্রেনিং ইন্সটিটিউট চালিয়ে আয় করলেও তা যথেষ্ট নয়। সবশেষে জনকণ্ঠকে কাতরকণ্ঠে হাসিব জানান, ‘এখনও ব্রাজিলে যেতে পাঁচ মাস সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে স্পন্সর পেলে আমি সব টেনশন ঝেড়ে ফেলে মন দিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারতাম।’
×