ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু শিক্ষায় ৯ প্রবীণ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

শিশু শিক্ষায় ৯ প্রবীণ

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ শিক্ষা গ্রহণের নেই কোন বয়সের সীমা, এমন দৃষ্টান্ত ওপরে স্থাপন করেছেন নবাবগঞ্জ উপজেলার ৯ শিক্ষার্থী। যাদের প্রত্যেকেরই বয়স ৪৫ বছরের ওপরে। প্রতিদিন নিয়ম মেনে আসছেন স্কুলে, নাতি-নাতনির বয়সের শিশুদের সঙ্গে নিচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষা। ‘চোখ থাকতে অন্ধ’ হতে চান না, আর দিতে চান না টিপসই বলেই তাদের শেষ বয়সে এসে শিক্ষা নেয়ার এই চেষ্টা। নবাবগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের দারিয়া এলাকায় মাহমুদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে দেখা যায়, খুব সকালে বই হাতে নাতি-নাতনির বয়সের ছোট শিশুদের সঙ্গে আসছেন বয়স্ক ৯ শিক্ষার্থী। অংশ নিচ্ছেন শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে। পরে তারা প্রত্যেকেই প্রবেশ করেন শ্রেণীকক্ষে, যেখানে পাঠদান করানো হয় ১ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের। জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম থেকেই বিদ্যালয়ে আসছেন ওই প্রবীণ ৯ জন। বিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন বই, নিয়মিত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ক্লাসে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছেন। দেখা যায়, শ্রেণীকক্ষে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১। ৯ বয়স্ক শিক্ষার্থী ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে ব্রেঞ্চে বসে ক্লাস করছেন। খুব আগ্রহভরে ক্লাসে পড়া শিখছেন। আবার ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই পড়া ভালভাবে বুঝিয়ে নিচ্ছেন ছোট ছোট শিশুদের কাছেই। ক্লাসে গিয়ে দেখা যায়, প্রবীণ এই বয়সে এসে ছোট শিশুদের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণে তাদের চোখে নেই এতটুকুও লজ্জা, বরং খুব আগ্রহ দেখা যায় চোখেমুখে। ওই প্রবীণ ওই ৯ শিক্ষার্থী হলেন- নবাবগঞ্জ উপজেলার আমবাগান এলাকার বাদশা মিয়া, একই এলাকার বদিয়াজ্জামান, মাহমুদপুর গ্রামের হারুনুর রশিদ, একই এলাকার ইলিয়াস মিয়া ও সিদ্দিক মিয়া, আমবাগান এলাকার আসাদ মিয়া, মেম্বারপাড়া এলাকার শাহিনুর আলম, একই এলাকার আব্দুল লতিফ ও সোনারপাড়া এলাকার লাল মিয়া। কথা হয় ৬২ বছর বয়সী বদিয়াজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্ত্রী খুব সকালে উঠে নাস্তা তৈরি করে আর নাতি তাকে ডেকে তুলে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য। তার নাতিও ওই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ভাত খেয়েই নাতিকে নিয়ে চলে আসেন বিদ্যালয়ে। তারপর দুপুরে ছুটি শেষে আবার বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, এই বয়সে বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন এতে তিনি যেমন খুশি, তেমনি খুশি তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে। ৭০ বছর বয়সী ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘ছোট থাকতে সংসারে অভাব ছিল, তাই পড়ালেখা করিনি। পড়ালেখা জানি না, তাই কোরআনের বাংলা অর্থ জানতে সমস্যা হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলা শিখব। পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলে তারা আগ্রহে আমাকে ভর্তি করে নেন।’ ৫৫ বছর বয়সী হারুনুর রশিদ জানান, এখানে যারা আছেন, তারা সকলেই গরিব ঘরের সন্তান। শিশু থাকতে পড়ালেখা হয়নি, ধরতে হয়েছে সংসারের হাল। এখন বৃদ্ধ তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাক্ষর করতে, বাংলা পড়তে সমস্যা হওয়ার কারণে তারা এখানে ভর্তি হয়েছেন। এই বিষয়টি এলাকার লোকজন ভালভাবে দেখছে, অনেকেই তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাদের দেখে অনেকেই বিদ্যালয়ে আসার আগ্রহ পাচ্ছে। আরও কয়েকজন ভর্তি হবে বলে জানান তিনি। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহিদুল ইসলাম জানান, প্রথমে ২ প্রবীণ তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি জানুয়ারি মাসে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনেই একসঙ্গে ভর্তি হন ৭ জন। এর ৩ দিন পরে ভর্তি হন আরও ২ জন। এখন এখানে মোট ৯ প্রবীণ শিক্ষা গ্রহণ করছেন। নিয়মিত তারা বিদ্যালয়ে আসছেন এবং তাদের শেখার আগ্রহ অনেক। কিছু না পারলে বা না জানলে শিক্ষকদের বুঝিয়ে নেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জেনাজুল হায়দার জানান, বয়স বেশি হওয়ায় ভর্তি নেয়া যাবে কি না এ বিষয়ে প্রথমে সমস্যা হয়। পরে শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করলে শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, আমাদের ৬ বছরের বেশি বয়সের শিশুকে ভর্তি করার নিয়ম আছে। বয়স বেশি হলে কোন বাধা নেই জানার পর ওই প্রবীণদের ভর্তি নেয়া হয়। তিনি জানান, এই প্রবীণরা সকলেই গরিব। তাই সাধারণ শিশুদের মতো তাদেরও উপবৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য প্রশাসনের কাছে জানানো হয়েছে।
×