ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য সেক্টরের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যোগসাজশের অভিযোগ

রোগী মারার কারখানা ॥ অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

রোগী মারার কারখানা ॥ অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি

নিখিল মানখিন ॥ বছরের পর বছর ধরে পরিদর্শনের বাইরে রয়ে যায় দেশের অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ শত শত বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এমন অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, অনুমোদনপ্রাপ্ত সেন্টারগুলোর খবরই নিতে পারে না সরকার। এর মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন না করেও চলে অনেক সেন্টার। আর অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কোন পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। স্বাস্থ্য সেক্টরের সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ সেন্টারগুলো চালু রাখার গোপন অনুমতি দিয়ে থাকেন। সারাদেশে এমন সেন্টারের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। বারবার ঘোষণা দিয়েও দেশব্যাপী কার্যকর অভিযান অব্যাহত রাখতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। বরং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ওই সব অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার লালন পালন করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। র‌্যাবের অভিযান প্রশংসিত হলেও ঘন ঘন অভিযান চালানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে দেশজুড়ে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। অধিকাংশ সেন্টারের নেই সরকারী অনুমোদন। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতালের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধ অভিযান অব্যাহত থাকবে। সরলতার সুযোগ নিয়ে এসব ক্লিনিকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দিনের পর দিন রোগীদের ঠকিয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ সব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশির ভাগ সরকারী হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়া হয় না। এখানে সবচেয়ে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুততম সময়েই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছেন। ভুঁইফোঁড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরা, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলাস্থানেই। নিয়ম অনুযায়ী এগুলো ইনসিনেটরে পোড়ানোর কথা। এসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়েমুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। অপরদিকে এই বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত সিøপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দ মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হলে পরেই চিকিৎসা। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছে মাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে বৈধ লাইসেন্সে মাত্র ৬ হাজার ৮৬৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে সেন্টারের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। শুধু রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৫টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৬৬০টি। কিন্তু বাস্তবে রাজধানীতে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কাঁচামাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বনে গেছেন। তাদের কাছে আধুনিক চিকিৎসাসেবার কোন গুরুত্ব নেই, আছে শুধু লাভের ফন্দিফিকির। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান : এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলেও সরেজমিন গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। জানা যায়, রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেয়া হয় তাদের। সেসব ক্লিনিকে গিয়ে সাইনবোর্ডে লিপিবদ্ধ কাউকে পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারী অনুমোদনপ্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নেই। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরকারী একটি রেট চার্ট দেয়া আছে। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি এ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫০০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫০০ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নির্ধারিত তালিকামূল্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ফি নেয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের অভিভাবকরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নিরাপদ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ এখনও চলছে। তালিকা তৈরির পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ এ অভিযান পরিচালনা করছে। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণকেও সোচ্চার হতে হবে। এ সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, দেশের ভাল ভাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।
×