ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বজনীন একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার জোরালো দাবি

পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতা-সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আন্দোলনে নামবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতা-সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আন্দোলনে নামবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রতিফলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিবর্তন প্রতিরোধে সারাদেশে বৃহত্তর শিক্ষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনের নেতারা বলেছেন, শিক্ষার মান এখন এমনিতেই সর্বকালের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে পাঠ্যসূচীতে সাম্প্রদায়িক চেতনা সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করার শতভাগ চেষ্টা করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের এই পরিবর্তনের মাধ্যমে সরকার হেফাজতে ইসলামের কাছে শুধু নতজানু হয়নি, আত্মাহুতি দেয়া হয়েছে। বুধবার সকালে রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রতিবাদে এক গোলটেবিল আলোচনায় শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এতে ‘পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-পরিপন্থী পরিবর্তন প্রতিরোধ-আশু করণীয়’ শীর্ষক একটি ধারণাপত্র পাঠ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। বৈঠকে বলা হয়, শিল্পী-কুশলীদের পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক ও শিক্ষাভিত্তিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে শীঘ্রই দেশব্যাপী এই আন্দোলন শুরু করা হবে। সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে বৃহত্তর শিক্ষা আন্দোলনের ডাক দিয়ে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। চিন্তার পরিবর্তনগুলো কেমন করে আসল তা এখন আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বজনীন একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের দাবি আরও জোরালো করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে পাঠ্যবইয়ে যারা নাম লেখেন, কিন্তু ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করেন না, তাদের ধিক্কার জানাই।’ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে এই গোলটেবিল বৈঠকে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘থলের বেড়াল তো হেফাজত নিজেই বের করে ফেলেছে। প্রেস কনফারেন্স করে সরকারকে যখন ধন্যবাদ দিল, তখনই বুঝতে আর বাকি থাকল না। শিক্ষামন্ত্রী সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা না দিলে দায়িত্ব নিয়ে তিনি পদত্যাগ করুন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। কারণ আমরা তাকে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবেই জানি।’ অনুষ্ঠানে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা, সম্পাদক ও নিরীক্ষকদের নিয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করা দরকার। তাদের জাতির সামনে মুখোমুখি করা প্রয়োজন।’ তিনি পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের ব্যাখ্যা চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে না পারে, তবে আমরা ভেবে নেব সরকার হেফাজতের দাবি পূরণেই পাঠ্যপুস্তকে এমন পরিবর্তন এনেছে। পাশাপাশি সরকারেরও এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেয়া উচিত।’ শিক্ষা ক্ষেত্রে সামন্তবাদী ও সাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাদের আমরা বিভক্তি, বিভাজন শেখাচ্ছি। এখন শেখাচ্ছি সাম্প্রদায়িকতা। এই দ্বিধাবিভক্ত প্রজন্ম কি করে ঐক্যবদ্ধ হবে?’ তিনি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটির সদস্য নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহীন মাহমুদের আশ্চর্য নীরবতার ও সমালোচনা করেন। শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসনের মধ্যে জামায়াত- বিএনপির চক্রটি টাকা দিয়ে সব কিনে নিচ্ছে। এভাবেই তো এসব হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করার শতভাগ চেষ্টা করা হয়েছে।’ নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম অভিযোগ করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী শক্তি কৌশলে আওয়ামী লীগ এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বনে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের ছেলে সালমান এফ রহমান এখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কি উপদেশ দেবেন, যার বাবা চেয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে?’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনবেন নাকি দুর্দিনে, সংগ্রামে পরীক্ষিত সৈনিক এই সাংস্কৃতিক জোটের কথা শুনবেন।’ নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক শিশুদের মনে কেমন ইমপ্যাক্ট ফেলে এটা কি সরকার জানে না। এই যে পরিবর্তন, এটা একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কমিটির দু’জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়, কমিটির সব সদস্যকেই সাসপেন্ড করতে হবে।’ বৈঠক শেষে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। দাবির মধ্যে রয়েছে, অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করে পূর্ববর্তী পাঠ প্রতিস্থাপনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ, পাঠ্যবই পরিবর্তনের তদন্ত করতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন, দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন বাধ্যতামূলক করা। পাঠ্যবইয়ে ভুল-ত্রুটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে সংসদীয় কমিটি ॥ সংসদ রিপোর্টার জানান, এনসিটিবি প্রকাশিত প্রাথমিকের পাঠ্য বইয়ে ভুল-ত্রুটি সম্পর্কিত সার্বিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদীয় কমিটি। বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে একটি সাব-কমিটিও গঠন করা হয়। সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের সাব-কমিটিতে আলী আজম ও মোহাম্মদ ইলিয়াছকে সদস্য রাখা হয়েছে। কমিটির সভাপতি মোঃ মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম ও সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে তিন সদস্যের আরও একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংসদ সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- মোঃ নজরুল ইসলাম বাবু ও মোঃ আবুল কালাম। দু’টি সাব-কমিটিকেই তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য মোঃ আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে একাধিক সদস্য প্রাথমিকের পাঠ্য বইয়ে ভুলভ্রান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু মন্ত্রী উপস্থিত না থাকায় কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। এজন্য সাব-কমিটি গঠন করা হয়। তিনি আরও জানান, পাঠ্য বইয়ের এ ধরনের ভুল মেনে নেয়া যায় না। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে। এতগুলো বই বিতরণের গৌরব কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে। কমিটির সদস্যরা ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। সংসদ সচিবালয় জানায়, বৈঠকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটি বিদ্যালয়ের শূন্য পদগুলো পূরণে দ্রুত নিয়োগ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিদ্যালয়গুলোতে দুই শিফ্ট চালু এবং বিদ্যালয় পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদারকরণসহ কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যালয় পরিদর্শনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্যানেল ও পুল শিক্ষকদের নিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে।
×