বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা টানা তিন বছর দেশব্যাপী ভয়াল সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অগ্নিসন্ত্রাসের জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করে বলেছেন, সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে তারা অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। শত শত নারী, শিশু, এমনকি স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত তাদের আগুন সন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পায়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে তারা আর এই পথে যাবে না। যদি তারা আবারও আগুন সন্ত্রাসের পথে যায় তাহলে জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে। কারণ, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকলেই কেবল কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব।
বুধবার দুপুরে গণভবনে ছাত্রলীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনের সর্বস্তরের নেতার সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রনেতাদের উদ্দেশ করে বলেন, নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে কাজ করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- জনগণকে জানাতে হবে। ভবিষ্যতে রাজনীতির নেতৃত্বে আসতে হলে দেশের স্বার্থে কাজে মনোনিবেশ করতে হবে।
জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও জনমত গড়ে তুলতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর প্রতি নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, মাদকাসক্তি শারীরিক, মানসিক ক্ষতি করে, ভবিষ্যতটাকে ধ্বংস করে দেয়। এটি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। সুতরাং, অকালে যেন কেউ মৃত্যুর মুখে ঝরে না পড়ে সেদিকে তোমরা অবশ্যই নজর দেবে এবং নেতা হিসেবে এটা তোমাদের দায়িত্ব। জঙ্গীবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করতে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোরহস্তে এগুলো দমনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা দেশবাসী, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্রসহ সকল শ্রেণী -পেশার মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলছি।
ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে শিক্ষাঙ্গনে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ক্যাম্পাসে কোন প্রকার অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে চায় না। অতীতে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ক্যাম্পাসে অস্ত্রের ঝনঝনানির জন্যই অনির্ধারিত বন্ধে বছরের পর বছর সেশনজট ছিল। দেখা গেছে- সেশনজটের জন্য অনেকেই পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করেই চাকরির বয়স শেষ হয়েছে। ছাত্র সমাজ এখন সেই দুঃসময় কাটিয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ততার ঘটনাগুলো তুলে ধরে বর্তমান প্রজš§কে আদর্শচ্যুত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৬২ সাল থেকে যখন আজিমপুর স্কুলে পড়তাম, স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব খুব কড়া ছিলেন। তাই অনেক সময় দেয়াল টপকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতাম মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে।’ ওই সময়ের মিছিলের সঙ্গে এখনকার মিছিলের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখন তো মিছিলের জায়গা খুবই কম। আমরা মিছিল করতাম সেই পুরান ঢাকায়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাবই, যাতে যারা কারাগারে আছে, তাদেরকে উৎসাহিত করা যায়। চকবাজার, মৌলভীবাজার, নবাবপুর হয়ে পুরো এলাকা আমরা ঘুরতাম তখন। লম্বা পথ পাড়ি দিতাম মিছিল করতে করতে। সারাদিন আমরা মিছিলে থাকতাম। এভাবেই কিন্তু আমরা সংগ্রাম গড়ে তুলেছি।’
সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে থাকা শেখ হাসিনা ছাত্রলীগে বিভিন্ন পদে ও ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকার কথাও নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম ছাত্রলীগের একজন ক্ষুদ্র কর্মী। বদরুন্নেছা কলেজ যেটা; সে সময় ছিল ইডেন ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ, সেই কলেজে আমি নির্বাচিত ভিপি ছিলাম। ছয় দফা দেবার পর যখন আব্বা, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সবাই কারাগারে বন্দী। ঠিক ওই সময় নির্বাচন করাটা কঠিন ছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছিলাম।’ বিভিন্ন পদে ও ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোন পদ না পাওয়ার ‘দুঃখের’ কথাও শোনান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সত্য কথা বলতে কি, পদ পেলাম আর না পেলাম, সে চিন্তা করে রাজনীতি করিনি। আমরা রাজনীতি করতাম জনগণের জন্য, দেশের জন্য, ছাত্রদের সমস্যা আমরা তুলে ধরতাম।’
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে তোমরা পড়াশোনা কর, নিজের জায়গা, আপন জায়গা; প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যেন ঠিক থাকে তার ব্যবস্থা করবে। প্রত্যেককে অন্তত তিনটি করে গাছ লাগানো, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোর খোঁজ নেয়া, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগ থেকেই উঠে আসবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত নেতৃত্ব। তোমরাই আসবে দেশের নেতৃত্বে। তিনি এ সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রশংসা করে বলেন, ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগেরই সভাপতি ছিলেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন। এভাবে তোমরাও দলের এবং দেশের নেতৃত্বে আসবে।
ব্যক্তিজীবনে সাশ্রয়ী, মিতব্যয়ী ও সৎ থাকতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মা-বাবা, দাদা-দাদি সবার কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছি, সেটি হলো মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটবে। তোমার জীবনের যতটুকু উপার্জন, যতটুকু তোমার আয়, যতটুকু তুমি ধারণ করতে পার, সেটুকু নিয়েই তুমি চলবে। তিনি বলেন, উপরের দিকে যদি তাকাও, আর কার কী আছে, কে কী করল, এ নিয়ে যদি চিন্তা কর, তাহলে জীবনে হোঁচট খেতে হবে, শান্তি নষ্ট হবে। জীবনে আর উন্নতি করতে পারবে না। নেতাকর্মীদের সৎ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সততাই তোমাকে মনোবল দেবে, শক্তি দেবে। আমি মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি একটা শক্তির বলে, যেটা মা-বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি। আমাদের সন্তানদেরও যে শিক্ষা দিয়েছি, তোমাদেরও সেই একই শিক্ষা দেব। তিনি বলেন, ধনসম্পদ, টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি কিছুই থাকে না, থাকে কেবল বিদ্যা। এই বিদ্যাই দেবে সব পথ খুলে।
দেশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে আসা ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন। তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পরিচিত হন, বিভিন্ন বিষয়ে অভিমত নেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বক্তব্য রাখেন।