ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাল চন্দ্র মিত্র

আইনের চোখে

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

আইনের চোখে

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। রাষ্ট্র শাসন কার্যে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে তাই প্রত্যাশিত। অস্টিনিয়ানের সংজ্ঞা মতে আইন সম্পূর্ণরূপে প্রাধিকারপ্রাপ্ত মানবাধিকার বিধান- যা রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত, প্রয়োগকৃত এবং সংরক্ষিত। রাষ্ট্রের আইন বিভাগ আইন সভার (পার্লামেন্ট) মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করেন, নির্বাহী বিভাগের (প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করেন এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনকে সংরক্ষণ করেন। রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোয় বসবাসকারী জনগণের অধিকার ও কর্তব্য, দায় ও দায়িত্ব নিরুপণ ও সংরক্ষণের নিমিত্ত নির্ধারিত ও নির্দেশিত এবং আদালত কর্তৃক বলবতযোগ্য বিধিবিধান, নিয়মকানুন, কাস্টমস এ্যান্ড কনভেনশনকে সমন্বিতভাবে আইন বলা হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ শৃঙ্খলা (ঝঃধঃব ধহফ ঝড়পরধষ ঙৎফবৎ) বজায় রাখার জন্য রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বাধ্য। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং কেউই আইনের উর্ধে নন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং চলতে দিতে হবে। আইনের আশ্রয় লাভের এবং আইনানুগ বিচার ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার নিরঙ্কুশ থাকবে। কোন ভাবেই কারও পক্ষ থেকে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা চলবে না। আইনের শাসনের মূল কথা এটাই। আইনের শাসন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। আইনের শাসন অব্যাহতভাবে জারি রাখা খুবই কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন আইনের প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ও মান্যতা। কিন্তু নির্মম হলেও বাস্তব সত্য এই যে, মানুষের মধ্যে আইন অমান্য করার প্রবণতাই বেশি। সুযোগ পেলেই মানুষ আইন অমান্য করবে বুঝে অথবা না বুঝেই। এক্ষেত্রে আইন প্রণেতা বা প্রয়োগকারী কেউই কম যান না। বিশেষ করে ক্ষমতাশালী ও প্রতিপত্তিশালী অভিজাত এবং দলীয় রাজনৈতিক কর্মী-ক্যাডাররা এক্ষেত্রে একটু বেশি অগ্রগামী। অনেক সময় আইনের নিজস্ব স্বাভাবিক গতিতে চলার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয় সচেতন ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে। ফলে আইনের শাসনের বিচ্যুতি ঘটে। আইনের শাসনের এটি একটি দুর্বলতার দিক। একটি রাষ্ট্র বা সমাজে আইনের শাসন বলবত আছে কিনা তা নির্ভর করে ওই রাষ্ট্র বা সমাজের মানুষগুলোর জীবনবোধ এবং আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। মিথ্যাবাদী, চাপাবাজ, দুর্নীতিবাজ, প্রতারণায় দক্ষ, অন্যের হক নষ্ট করায় উন্মুখ সমাজে আইনের শাসন নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশে অতীতে আইন জারি করে (বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধের এবং ক্লিনহার্ট ইনডেমনিটি) আইনের শাসন বিঘিœত করার অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। এ রকম অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টান্ত থাকার পরেও বলা যায় বাংলাদেশে আইনের শাসন নানা রকম বিচ্যুতি সত্ত্বেও বলবত আছে। গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক শাসন চালু আছে। সংসদ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কার্যকর রয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে বিচারকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে ও দ- কার্যকর হচ্ছে। ক্ষমতাসীন এমপি ও মন্ত্রীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশদেরও ছাড় দেয়া হচ্ছে না। এ সবই আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত। নানা অসঙ্গতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নমুখিতা বজায় রয়েছে। কোন অরাজক মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আইনের হাত অনেক লম্বা এবং এর স্থান অনেক উঁচুতে। তবে সেখানে পৌঁছাতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, আইনের প্রয়োগে যদি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় তা হলে আইন তার নিজস্ব গতি হারাতে বাধ্য হবে এবং আইনের শাসন বিঘিœত হবে। শান্তিবাগ, পটুয়াখালী থেকে
×