ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নগরপিতা ও হকারদের খালিপেট -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

নগরপিতা ও হকারদের খালিপেট -স্বদেশ রায়

পল্টন, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, মৌচাক, বেইলি রোডের অনেক হকারকে অনেক দিন থেকে চিনি। আবার কখনো শুনেছি তাদের একজন মারা গেছেন। মৃত্যুর খবর শুনে মনটা একটু হলেও কেমন আনমনা হয়েছে। ভাবতে চেষ্টা করেছি, গ্রামের বাড়িতে কীভাবে তাঁর মরদেহটি পৌঁছেছিল, কেমন শোকাতুর হয়েছিল সে বাড়িটি; আর এখন কীভাবে চলে তাঁর সংসার! কোন কোন হকারকে দেখেছি, সঙ্গে নিজের ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে আসতেন। ছেলেটা অতি উৎসাহী হয়ে সবাইকে খরিদ্দার মনে করে ডাক দিত। তাতে ফুটপাথের কাউকে কাউকে রাগতেও দেখেছি। আবার কয়েকজনের মুখ দেখে কখনও মনে হয়েছে, এই জিনিসটি তাঁর প্রয়োজন ছিল না, কচি মুখকে সন্তুষ্ট করতে কিনেছেন। সাংবাদিক মন, খোঁজ নিতে নিতে কে কোন্ রাজনীতি করেন, কেউ বা রাজনীতি না করে কত টাকায় সাবের চৌধুরী বা মির্জা আব্বাসের মিটিংয়ে যান; কার বিরিয়ানি কেমন ছিল এসব গল্পও তাঁদের কাছে শুনেছি। আবার হকার থেকে অনেককেই তো কোটিপতি হতে দেখলাম। রাস্তার পাশে বসে পেঁয়াজু বিক্রি করতেন এখন বড় শপের মালিক। দেখে ভাল লাগে, কীভাবে একজন লেখাপড়া না জানা মানুষ, সংগ্রাম করে জীবনকে বদলে ফেললেন। আবার কাউকে দেখি, দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মুখের ভাঁজ খাওয়া চামড়া দেখে কখনও কখনও নিজের হাতের কুঁচকে যাওয়া ত্বকের দিকে তাকাই। হঠাৎ গত কয়েকদিন হলো আবার হকারদের মুখ দেখছি টিভি পর্দায়। চেনার চেষ্টা করছি, সেই ছোট ছেলেদের কেউ তাদের ভেতর আছে কিনা? চেনা মুখ পাই না তবে চেনা অসহায়ত্ব পাই। বেগম জিয়ার সেই মানুষ পোড়ানো অবরোধের সময় অনেক হকারের সঙ্গে দেখা হতো- এগিয়ে এসে জানতে চাইতেন, এগুলো কবে শেষ হবে? আমাদের পেটে কেন লাথি মারছে? বলতেন, আমরা খাব কি? টিভি পর্দায় গত কয়েকদিন কিন্তু মানুষগুলো একই কথা বলছেন। আমাদের ফুটপাথ থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, আমরা কোথায় যাব? আমরা খাব কি? ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে বাঁচব? হকারদের এ কথায় যে মধ্যবিত্ত মন নাড়া দেয়নি- এটা সত্য। কারণ, মধ্যবিত্ত মন নাড়া দিলে তাদের নিয়ে অনেক খবর হতো। বরং এখন খবর হচ্ছে সহজে এখন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছেন মানুষ। খুব খুশি মধ্যবিত্ত। যিনি ফুটপাথ দিয়ে কখনও হাঁটবেন না তিনিও খুশি। তবে নগরীর এই ফুটপাথ জুড়ে যারা বেশি হাঁটেন তাঁরা খুশি কিনা সে খবর এখনও মিডিয়াতে আসেনি। তাঁরাই মূলত ফুটপাথ ধরে বেশি হাঁটে যারা মতিঝিল থেকে পল্টন আসতে আসতে অনেক কিছুই কেনেন এই হকারদের কাছ থেকে। মধ্যবিত্ত যেমন ফুটপাথে হাঁটতেও যায় না তেমনি কিনতেও যায় না। তাদের সর্বনিম্ন বাহক হলেও রিক্সা আছে। আর কেনার জন্য শপিং মল আছে। তারা সাজিয়ে রাখা পাঁচ দোকানে ঢুকে দশটি মাল নেড়ে তারপরে একটি কেনেন। আর ওই যাদের কোন বাহন নেই, যারা ফুটপাথ ধরে হাঁটে ওরাই কিন্তু মূলত এই হকারদের ক্রেতা। এরা চলতি পথে ফুটপাথ থেকেই তাদের ছেলের জন্য জিন্সের প্যান্ট কেনেন, শার্ট কেনেন। ছোট্ট একটি বাচ্চা। অফিসে অফিসে দুপুরের খাবার বিক্রি করে। পরনে জিন্স ও একটি চেক শার্ট। বেশ স্মার্ট লাগে তাকে দেখতে। শার্ট-প্যান্ট মিলে তার দেড় শ’ টাকাও লাগেনি। আসলে অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী যদি আমরা দেখি তা হলেও কিন্তু সহজে বোঝা যায়- ডিমান্ড এবং সাপ্লাই একত্র হলেই মার্কেটের সৃষ্টি হয়। আসলে ফুটপাথ ধরে যারা হেঁটে চলেন তাদের ওই ফুটপাথে পণ্য কেনার প্রয়োজন আছে বলেই কিন্তু ফুটপাথে ফুটপাথে ভাসমান মার্কেটের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। এর সঙ্গে আরও দুটি বিষয় এখানে যোগ হয়েছে, এক. ফুটপাথে যারা কেনেন তাদের ক্রয়ক্ষমতা ওই পর্যন্তই : আর যারা ওই মাল বিক্রি করতে ওখানে আসেন তাদেরও পুঁজির পরিমাণ ওইটুকুই। এর বেশি পুঁজি দিয়ে দোকান কেনা, সাজানো তারপরে মাল তোলা- এগুলো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন আমাদের অনেক মধ্যবিত্ত বলেন, ওয়াশিংটনে তো এমন ফুটপাথে ভিড় দেখি না (অবশ্য ওয়াশিংটনের ফুটপাথেই সস্তায় বই কেনা যায়), সিঙ্গাপুরে তো দেখি না। আমরা কেন আমাদের ঢাকা শহরকে ওই সব শহরের মতো বানাতে পারব না। মধ্যবিত্তের এ চিন্তায়, এ তর্কে কখনও যোগ দিতে নেই। তবে দেশের যারা পরিচালক, নগরীর যারা পিতা হয়েছেন, তারা সন্তানদের একটু চিনলে ভাল হয়। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে রাখলে আরও বেশি ভাল হয়, ঢাকা শহরটি বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন একটি অংশ নয়। এটাকে দেশ থেকে আলাদা করে ওয়াশিংটন, সিঙ্গাপুর বা ভিয়েনা বানানোর কল্পনায় না গিয়ে ঢাকা কী, কোথায় অবস্থিত, কোন্ দেশের রাজধানী, দেশটির জনসংখ্যা কত, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকা- কোথায় কতটুকু কীভাবে হচ্ছে- এগুলো আগে ভেবে দেখা দরকার। মাথাপিছু এক হাজার ডলার আয়ের একটি দেশের ষোলো কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকা। ষোলো কোটি মানুষের জন্য মোট স্থান ৫৪ হাজার বর্গমাইল। তার অর্ধেকের বেশি নদী ও সমুদ্র। অর্থনৈতিক কর্মকা- এককেন্দ্রিক। প্রশাসন এককেন্দ্রিক। কোনটাই বিকেন্দ্রিকীকরণ হয়নি। টানা সামরিক শাসনের কারণে দেশের রাজধানীকেও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়নি। অর্থনীতি ও প্রশাসন এককেন্দ্রিক হওয়াতে ষোলো কোটি মানুষের ভেতর থেকে প্রায় দুই কোটি এখন ঢাকায়। তার ভেতর এক কোটি নিম্নবিত্ত। এই এক কোটি- কে কোন্ রকমের পেশায় আছে এবং তাদের উদ্ভাবনী দিয়ে পেশা তৈরি করে নিয়ে জীবিকা চালাচ্ছে তার খুব কম খোঁজই কিন্তু মধ্যবিত্ত পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে তারা খেয়াল না করলেও যখন যে ধরনের সেবা দরকার সেই ধরনের সেবাই তাঁরা কিন্তু পাচ্ছেন এই নিম্নবিত্তের মানুষগুলোর কাছ থেকে। শওকত ওসমান, কাজী নজরুল ইসলামেরই উত্তরাধিকার। তাই তিনি প্রায় বলতেন, সেই দিন মনটা ভাল হবে যেদিন আর মানুষ মানুষকে বহন করবে না। মানুষকে রিক্সা চালাতে দেখলেই তাঁর চোখটা কেমন যেন হয়ে যেত। মানুষের চালানো রিক্সা কিন্তু কমে আসছে। বিদ্যুত উৎপাদনের পর থেকে, ধীরে ধীরে ব্যাটারি চালিত রিক্সা এসে গেছে দেশের সব জায়গায়। দরিদ্র জনসংখ্যাভারে ভারাক্রান্ত একটি দেশ ধীরে ধীরে এভাবেই পরিবর্তন হয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। দরিদ্রকে জোর করে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে, দারিদ্র্য ঢেকে রেখে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। যেভাবে বর্তমানে হকার উচ্ছেদ হচ্ছে এর ভেতর কিন্তু অনেকটা সঞ্জয় গান্ধীর সেই দিল্লীর বস্তি উচ্ছেদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হকাররাও সেটা বুঝতে পেরেছেন তাই তাঁরা কিন্তু মেয়রের কাছে এখন আর তাদের কষ্টের কথা বলতে চাচ্ছেন না। তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাচ্ছেন। কারণ, তাঁরা জানেন, শেখ হাসিনা দেশকে চেনেন, দেশের মানুষকে চেনেন। তিনিই বুঝতে পারবেন ফুটপাথের এই হকারদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেমন হাজার মানুষের ব্যবসা, তেমনি লাখ লাখ মানুষের কম খরচে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা। তাই এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিপাকে ফেলা নয়। বরং কত দ্রুত দেশের উন্নয়ন করে, অর্থনৈতিক কর্মকা- দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া যায় সেটাই দেখা দরকার। যেমন উদাহরণ তো সামনে আছেই, বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াতেই এখন মানুষে কম রিক্সা টানছে, ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলছে। তেমনি পদ্মা সেতু হয়ে গেলে, সেতুর দুই পারে অর্থনৈতিক কর্মকা- বেড়ে যাবে। তখন ওই দুই পার থেকে যে হকাররা এসেছেন তারা নতুন কাজে চলে যাবেন। আবার ওখান থেকে যে নিম্নবিত্তরা ঢাকায় এসেছেন, বিভিন্নভাবে বাঁচার চেষ্টা করছেন, যারা মূলত ফুটপাথের ক্রেতা- তারাও তখন চলে যাবেন নিজ নিজ এলাকায়। এমনি ভাবে যখন পায়রা বন্দর হবে, দক্ষিণের মানুষ তখন বন্দরের দিকে ছুটবেন। ঢাকায় আসবেন না। মেয়রদেরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জায়গা আছে। তাঁদের কাজ কিন্তু শুধু রাস্তা ঝাড়ু দেয়া আর হকার উচ্ছেদ নয়। এগুলো অনেক কাজের ভেতর একটি। মেয়ররা যে তার নগরীতে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, শিল্প প্রতিষ্ঠান এগুলো সিটি কর্পোরেশনের অধীনে গড়ে তুলতে পারেন- তার উদাহরণ চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী রেখে গেছেন। তাছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনীর ভেতর দিয়ে উন্নয়নে সহযোগী হতে হবে মেয়রদের। জনঘনত্বপূর্ণ দেশে অধিক মানুষের রুটি রুজি যেখানে জড়িত সেখানে সামরিক শাসকের মতো মাথাব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত না নেয়াই ভাল। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী দেশে ছিলেন না। তিনি নিশ্চয়ই এখন হকারদের বিষয়টি দেখবেন। কারণ, দেশের মানুষ জানে একজন সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তির চেয়ে একজন গরিব শেখ হাসিনার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। দারিদ্র্য দূর করার ব্রত নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন। সামরিক শাসকের লাঠি হাতে তিনি রাজনীতি করছেন না। তিনি বাস্তবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রকৃতির যে সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন সেই প্রকৃতিকেই লক্ষ্য করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ দেশের মাটি বর্ষায় যেমন কোমল চৈত্রের রোদে তেমনি কঠিন হয়। এ দেশের সাধারণ মানুষ জানে শেখ হাসিনার হৃদয় তাদের জন্য বর্ষার মাটির মতো কোমল আবার এখন দেখছে জঙ্গী বা আগুন লাগানো দুর্বৃত্তদের জন্য চৈত্রের মাটির মতো কঠিন। হকারদের কর্মসূচীতে দেখছি তাঁরা শেখ হাসিনার কাছে তাঁদের আবেদন জানাবেন। দক্ষিণের মেয়রকে বলব, শেখ হাসিনার মতো হৃদয় দিয়ে দেখে সমস্যাটির সমাধান করুন। কলকাতা আমাদের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দরিদ্র দেশের একটি শহর। সেখানে তারা যেভাবে হকারকে ফুটপাথের সঙ্গে নানা সময়ে নানাভাবে বসতে দিয়ে সমাধান করছে সেভাবে করুন। সন্ধ্যা ছয়টার পরে তো ক্রেতা কমে যায়। তাই সময়গুলো পরিবর্তনসহ বাস্তবতাকে অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত নিলে অনেক ভাল হবে। তাছাড়া একটা বিষয় এ দেশের নাগরিক ও রাজনীতিবিদদের সব সময়ই মাথায় রাখা ভাল, আমাদের দেশ জনঘনত্বপূর্ণ, আমাদের মানুষের ভিড় একটু বেশি সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। এর ভেতরই উন্নয়ন করতে হবে। বিদেশে বেড়াতে গিয়ে তাদের শহর দেখে নিজ শহর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত না দিয়ে দেশটাকে চিনে আমার দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ কীভাবে করা যায় সেটাই ভাবতে হবে। হকাররা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, তারা শেখ হাসিনার কাছেই তাদের বাস্তবতা তুলে ধরবেন। আশা করা যায় শেখ হাসিনা এমন একটা পথ দেখাবেন, যাতে ওই যে হকাররা বলেছিলেন খালেদা জিয়া কেন আমাদের পেটে লাথি মারছে তারা যেন আবার না ভাবেন তাদের পেটে লাথি পড়ল! আর মেয়রদের মনে রাখতে হবে, মধ্যবিত্তকে কাজ দেখাতে গিয়ে তারা যেন দরিদ্র’র ওপর সঞ্জয় গান্ধী না হয়ে ওঠেন। আজ যে দরিদ্রকে নিয়ে সমস্যা, হকার সমস্যা- এর মূল সমাধান কিন্তু শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। ২০১৯-এর পরে আরও টানা দশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এমন উন্নয়ন হলে তখন কিন্তু হকার সমস্যা এমনি সমাধান হয়ে যাবে। তখন ফুটপাথের ক্রেতা ও হকার দুই-ই শপিং মলে স্থান নেবেন। [email protected]
×