ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিপিন্সে মাদকবিরোধী যুদ্ধ অব্যাহত

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

ফিলিপিন্সে মাদকবিরোধী যুদ্ধ অব্যাহত

ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে গত ৩০ জুন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সে দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধে ৬ হাজারেরও বেশি নর-নারী নিহত হয়েছে। হাজার হাজার মাদক অপরাধীকে হত্যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুর্তাতে ৯ মের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পরই তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি করেননি। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ড্রাগ স্কোয়াডের হাতে বিভিন্ন শহরে লাশ পড়া শুরু হয়। সেটা এখনও থামেনি। মাদক কারবারী ও মাদকাসক্তদের রহস্যময় গ্যাংল্যান্ড স্টাইলে রাতের বেলা গুলি করে মারা হচ্ছে। তাদের লাশ পড়ে থাকছে কখনও মহাসাগরে, কখনওবা বস্তি এলাকায়। কোন কোন লাশের হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা মুখে টেপ লাগানো কোন লাশের সঙ্গে কার্ডবোর্ডে লেখা ‘আমি মাদক কারবারী আমার মতো পরিণতি যেন কারোর না হয়।’ মাসখানেক আগে ফিলিপিন্সের পুলিশ বাহিনী বলেছে যে প্রেসিডেন্ট দুতার্তের মাদকবিরোধী যুদ্ধের জালে ১০ লাখেরও বেশি নর-নারী কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, গ্রেফতার হয়েছে অথবা নিহত হয়েছে। পুলিশপ্রধান ডেলা রোজা জানান যে, মাদকবিরোধী যুদ্ধের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার ৭০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১০ সালের জরিপের ভিত্তিতে ফিলিপিন্সে মাদক কারবারী ও মাদক সেবার সংখ্যা ১৮ লাখ। তবে দুতার্তের হিসাবে এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ লাখ হতে পারে। ডেলা রোজা জানান যে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদকবিরোধী পুলিশী অভিযানে ২১৫৭ জন নিহত হয়েছে। তবে অন্যান্য সূত্রে বলা হয় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়ে যাবে এবং পুলিশ ছাড়াও এসব হত্যাকা-ে অংশ নিয়েছে ভিজিলেন্ট গ্রুপ ও অন্যান্যরা। এসবই বিচারবহির্ভূত হত্যা। দুতার্তে নির্বাচনী প্রচারের সময় ছয় মাসের মধ্যে অপরাধ ও মাদক দমনে অভিযান চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ জনসমর্থন পেয়েছিলেন। তিনি যে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটাবেন সেটা আর রাখঢাক করেননি। নির্বাচিত হওয়ার এক মাস আগে এপ্রিল মাসে তিনি বলেছিলেন : ‘তোমরা যারা মাদক কারবারে ও মাদক সেবনে আছ তারা সবাই কুত্তার বাচ্চা। আমি সত্যিই তোমাদের মেরে ফেলব।’ কথাটা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য শুধু শত কা শত ছিল না। ২২ বছর দুতার্তে দক্ষিণের দাভাও নগরীর মেয়র থাকাকালে জনজীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলে নির্মম ভূমিকা নিয়েছিলেন। দাভাও যে ডেথ স্কোয়াডদের দিয়ে অপরাধী ও মাদকসেবীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা কার্যত তার রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। গত ডিসেম্বর মাসে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে দুর্তাতে স্বীকার করেন যে মেয়র থাকাকালে তিনি নিজের হাতেও দু’চারজনকে মেরেছিলেন। কিন্তু ফিলিপিনোদের অনেকে মাদকবিরোধী যুদ্ধের সুফলকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছে তাদের মনোভাব অনেকটা এ রকম : হত্যাকা- খারাপ। কিন্তু মাদক ও অপরাধে জর্জরিত সমাজ তার চাইতেও খারাপ। ডিসেম্বরে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেয়া যায় যে শতকরা ৭৭ ভাগ ফিলিপিনো দুতার্তের মাদক ও অপরাধবিরোধী ভূমিকায় সন্তুষ্ট। কোন কোন ফিলিপিনো মহিলাকে এমন প্ল্যাকার্ড হাতে দেখা গেছে ‘আমি একজন ফিলিপিনো এবং আমার প্রেসিডেন্ট দুতার্তে।’ ৭১ বছর বয়স্ক দুতার্তে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ালে তাকে কালো ঘোড়া হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। অর্থাৎ কতকটা অচেনা, অপরিচিত প্রার্থী হিসেবে তার সম্ভাবনা তেমন উজ্জ্বল ছিল না। কিন্তু মোহমুক্ত ফিলিপিনোরা অচিরেই তার চারপাশে এসে সমবেত হয়। তারা মাদক সমস্যাকে একটা মহামারী হিসেবে এবং সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার লক্ষণ বলে গণ্য করে। তারা এই সমস্যার ব্যাপারে সর্বাধিক সোচ্চার দুতার্তেকে সমর্থন জানায়। তারা প্রেসিডেন্ট ওবামা ও পোপ ফ্রান্সিসকে ‘শুয়ারের বাচ্চা’ আখ্যায়িত করার জন্য দুতার্তের মধ্যে অন্যায় কিছু খুঁজে পায়নি। বরং তার এই অমার্জিত ভাবটা তাদের পছন্দ হয়েছে। দুতার্তে সহিংসতার প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে তারা একজন পরিবর্তনের বাহনকে খুঁজে পেয়েছে বলে মনে করে। কারণ দুতার্তের ব্যক্তিগত রেকর্ড তুলনামূলকভাবে অনেক স্বচ্ছ। দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী শাসক ফার্ডিনাও মার্কোসের পতন ঘটার পর ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ফিলিপিন্সে গণতন্ত্র আসলেও রাজনীতি এখনও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর। ২০১৩ সালে ফিলিপিন্সের হত্যাকা-ের হার ছিল এশিয়ার সর্বোচ্চ। অন্যদিকে মেথাম ফিটামিনের ব্যবস্থা ও ভোগ ব্যবহার ভয়াবহ হারে বেড়েছে। ফিলিপিন্সের পর্যটন শিল্পে প্রতি ১০ জন নাগরিকের একজন নিয়োজিত পর্যটন খাত জিডিপির ৭.৮ শতাংশ যোগায়। অথচ দুর্নীতি ও অযোগ্যতায় খাতটি ধরে পড়ছে প্রায় ১০ কোটি লোকের জনগোষ্ঠীর মোটামুটি এক- চতুর্থাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। ফিলিপিন্সের বর্তমান মাদকবিরোধী যুদ্ধের যে সব বিবরণ প্রচার পেয়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে পশ্চিমী দুনিয়ায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার বলেছেন হত্যাকা-ের জন্য দুতার্তের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ও তার সমর্থক ফিলিপিনোরা উত্তরোত্তর বৈরী পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে তাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দুতার্তে ফিলিপিন্সকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বের করে এনে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তুলেছেন। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও দুই সরকারের মধ্যে বেশ কিছু সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে এবং ফিলিপিন্স চীনের কাছ থেকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা লাভ করেছে। চীন ফিলিপিন্সের অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এতে এই অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি ও মর্যাদার ওপর আঘাত নেমে এসেছে। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×