ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ

বিশ্ব রাজনীতির নতুন ও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে জানুয়ারি ১৭ থেকে ২০ পর্যন্ত বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন সুইজার ল্যান্ডের ডাভোসে। পশ্চিমা অভিজাত রাজনৈতিক নেতৃত্ব আজ প্রশ্নের মুখে। নিজেদের স্বার্থেই পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার করতে হবে তাদের অবস্থান। তাদের শেষ সম্মিলনের পর অনেকটাই বদলে গেছে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট। বলা যায় তাদের পরিকল্পনা আর আশার বিপরীত চিত্র বদলে দিয়েছে প্রেক্ষাপট। সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুটি পরিবর্তন হলো নতুন মার্কিন নেতৃত্ব ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া যা আলোচিত ব্রেক্সিট নামে। তাদের বিবেচনায় নিতে হচ্ছে পুতিনের নেতৃত্বে নতুন এক রাশিয়ার উত্থান, তুরস্কের নতুন পথে যাত্রা। দুতের্তে, কিম জং উন বা এশিয়ার জেগে ওঠা নতুন শক্তিগুলোর ভূমিকা। নিঃসন্দেহে ডাভোসে বিশ্ব নেতারা ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল পর্যায়ে বিষয়গুলো নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। রাজনীতির বিচিত্র জগতে গতকালের শত্রু আজ প্রাণের বন্ধু। তার পরও পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে। বিশ্ব নেতারা নিশ্চিতভাবেই সে হিসাব মেলাতে চাইবেন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। তাদের এবারের সম্মিলনের পূর্বে আলোচ্য প্রেক্ষাপটগুলো দেখে নেয়া যাক। ১৯৯১-এর ২৫ ডিসেম্বর রাতে পরিবর্তিত সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পাশ্চাত্য পরিম-লে নেতৃত্বের ছিল ভিন্ন প্রত্যাশা। নতুন রাশিয়ার কাছে কাম্য ছিল অধিকতর সহযোগিতা সম্ভবত এক নতজানু বন্ধুসুলভ রাশিয়া। নতুন মূল্যবোধ, আচরণ আর নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত অনুগত রাশিয়া। কিন্তু বিধ্বংসী ৯০ দশকের পর পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দের কাছে এটি পরিষ্কার রাশিয়ার পথচলা তাদের প্রার্থনার সমান্তরাল নয়। পুতিনের যুগ শুরু আর তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে সামনে রেখে রাশিয়া আজ বিশ্ব মঞ্চে কম বন্ধুসুলভ এবং এক আগ্রাসী দেশ। তুরস্ক হাঁটছে নতুন পথে। ১৯৯৯ এ আঙ্কারাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদের জন্য আবেদন দাখিল করতে। পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দের প্রত্যাশা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কাক্সিক্ষত জোট সদস্যপদ তুরস্ককে ধরে রাখবে গতান্ত্রিক পথে। কিন্তু পুতিনের হস্তক্ষেপে বদলে গেছে চিত্র। এরদোগান ফিরে গেছেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের ধারণায়, পুতিন আর এরদোগানের বার্তা পরিষ্কার ‘পাশ্চাত্য নিদের্শিত পথ নয়। আমরা আমাদের পথে চলব এবং আমাদের মেনে নিতে হবে আমাদের মত করে।’ বছরের পর বছর মার্কিন ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাশিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলোকে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের ইচ্ছাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীনতা আর কতৃত্বের ভিত্তিতে নতুন মর্যাদায় দাঁড়িয়েছেন পুতিন, এরদোগানের মত নেতারা। মার্কিন রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান এক্ষেত্রে ভিন্ন। ট্রাম্পের অভিষেক পুতিন আর এরদোগানের জন্য এক উপহার- ট্রাম্প তাদের গ্রহণ করতে চান তাদের মতো করে। ট্রাম্প তাদের বিষয়ে তাদের নিজস্ব মতামতকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। একই সঙ্গে আমেরিকা সংক্রান্ত তাদের পরামর্শে আগ্রহী নন। তুরস্ক-রাশিয়ার মেলবন্ধন : তাদের বর্তমান বন্ধুত্ব পরিস্থিতির দাবিতে। স্বাভাবিক মিত্র তাদের বলা যায় না। কিন্তু রাশিয়ার জেটের বোমাবর্ষণের পরও দু’দেশের নেতৃত্ব তাদের সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী। মনে রাখতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে অন্যতম প্রভাবশালী ভূমিকা পালনকারী ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক। আর মেডিটোরিয়ানে রাশিয়ান ব্ল¬্যাক সি ফ্লিটের একমাত্র প্রবেশপথ তুরস্ক। পারস্পরিক সন্দেহ অতীতে অনেকবারই সম্পর্কে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া ও তুরস্কের দুই প্রেসিডেন্টই উচ্চাকাক্সক্ষী, কিঞ্চিত অহং তাড়িত আর নিজ দেশের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । পুতিন ইতোমধ্যে তার স্বপ্ন ছুঁয়ে দিয়েছেন। এরদোগান জন ম্যান্ডেটে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা দু’জনেই জানেন যে কোন আঘাত ফিরিয়ে দেয়ার মতো ক্ষমতা তারা রাখেন। আর দু’জনেই যখন দু’জনের প্রত্যাশা পূরণে সমর্থ তখন সাময়িক বন্ধুত্ব হলেও তা সম্ভব। সেই নবেম্বর ২০১৫ তে তুরস্কের আকাশ সীমায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়ান জোটের উপস্থিতির জবাব এরদোগান দিয়েছেন রাশিয়ান প্লেন ভূপাতিত করে। বার্তাটি পরিষ্কার-ছোট মনে করে আমাকে অবহেলা করা চলবে না, আর গত জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর এরদোগান ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওবামা প্রশাসনের সমালোচনা অগ্রাহ্য করে বিরোধীদের ওপর ছিলেন খড়গহস্ত। এখানেই পুতিন খুঁজে নিয়েছেন তার সুযোগ। এরদোগানের প্রতি তার সমর্থন তুরস্ককে করেছে রাশিয়ানির্ভর। ক্ষমা চেয়েছে তুরস্ক রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার জন্য। সাহায্য চেয়েছে সিরিয়ার কুর্দিদের মোকাবেলায়। যে কারণে রাশিয়া আজ তুরস্কের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। এমনকি আঙ্কারায় নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত হত্যার পরও উভয় দেশ একযোগে নিন্দা জানিয়েছে সন্ত্রাসবাদের। রাজনৈতিক মঞ্চে ট্রাম্পের প্রবেশ বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে উদয় ঘটেছে পুতিন আর এরদোগানের নতুন প্রতিপক্ষ। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বিশ্ব রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা। মার্কিন-তুর্কী-রুশ এক নতুন জোট। ট্রাম্পের সিরায়াকেন্দ্রিক প্রাথমিক চাওয়া আইএসকে গুঁড়িয়ে দেয়। ট্রাম্পের মতে মার্কিন ভোটাররা কোন আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি দায়বদ্ধ নয়। যা সিরায়াতে তুরস্ক-রাশিয়া ইতোমধ্যেই ভঙ্গ করেছে। ট্রাম্পের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে কোন হুমকি উৎখাত করাই প্রধান তা সে যেভাবেই হোক। নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখলে এ এক নতুন চিত্র। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন মার্কিন করদাতাদের অর্থে বিশ্ব পুলিশের ভূমিকায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে চান না। তার অবস্থান স্পষ্ট- যুক্তরাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের নিরাপত্তা। তিনি পুরনো মূল্যবোধ বয়ে বেড়াতে আগ্রহী নন। ট্রাম্প চলতে চান নতুন পথে। তার পক্ষে যা কিছু সুফলদায়ক তিনি তার পক্ষে। তাই জানুয়ারি ১১-এর প্রেসকনফারেন্সে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন ‘পুটিন যদি আমাকে পছন্দ করে থাকেন তা আমার অর্জন কোন দায় নয়।’ এদিকে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ এ অবস্থা মোকাবেলার খুব একটা প্রস্তুত নন। ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া তথা ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয় এখনও। ট্রাম্পের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিপরীত। আবার পুতিনকেও সহজভাবে নিতে পারছেন না তারা। ক্রিমিয়া নিয়ে পুতিনের অবস্থান তাদের ফেলেছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। শরণার্থী সমস্যায় ইতোমধ্যেই বিব্রত ইউরোপীয় নেতারা। আবার এরদোগানকে মোকাবেলার কোন কার্যকর পথ নেই তাদের সামনে। অপরদিকে এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের। এটি এখন পরিষ্কার স্নায়ূ যুদ্ধোত্তর পরবর্তী বিশ্বের চিত্রটি ডাভোসে একত্রিত বিশ্ব নেতাদের অনেকের কল্পনা বা চাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা জানেন বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার মার্কিন নেতৃত্ব নিজ স্বার্থে যে কারও সঙ্গে হাত মেলাবেন। আর ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবানদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্ব সমাজের কাছে দায়বদ্ধ নয়। আর দশটা দেশের মতোই নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে চলা এক দেশ। ডাভোস সম্মেলনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে প্রথমবারের মতো কোন চাইনিজ প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি। তার উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে চায়নার অবস্থানের বার্তা দেবে। এটিও দেখবার বিষয় নিষেধাজ্ঞা নিয়েও চায়না কতদিন তার পথ ধরে রাখবে। নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দেখার অপেক্ষায় তুর্কী রাশিয়া-মার্কিন বলয় কতদিন টিকে থাকবে। একই রকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর স্বার্থ এই তিন দেশের নেতৃত্বকে আজ দাঁড় করিয়েছে এক মঞ্চে। আর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর স্বার্থের সংঘাত তাদের অচিরেই বিচ্ছিন্ন করবে বলে ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। মূল্যবোধহীন কেবল স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোন ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী যা সুফলদায়ক হয়নি কখনই। এখন কেবল দেখার অপেক্ষা। তার আগে এ কথা বলাই যায় নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতি। সূত্র : টাইম
×