ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ৪৫০ কুয়া খনন করা হবে ॥ কৃষিমন্ত্রীর উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল এখন আশীর্বাদ

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির চিত্র বদলে যাচ্ছে পাতকুয়া প্রযুক্তিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির চিত্র বদলে যাচ্ছে পাতকুয়া প্রযুক্তিতে

কাওসার রহমান ॥ একটি উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির চিত্র। স্বল্প পানি খরচে অধিক ফসল আবাদের এ প্রযুক্তিটি ওই অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কৃষিমন্ত্রীর উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা থেকে এ প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বহুমুখী ফসল উৎপাদনে সেচকাজের এ প্রযুক্তির নাম দেয়া হয়েছে ‘পাতকুয়া প্রযুক্তি’। পরীক্ষামূলকভাবে খননকৃত ছয়টি পাতকুয়ার সফলতার পর পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে এ প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে দিতে ৪৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে। ফলে সেচকাজের জন্য পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কোন কোন এলাকায় নলকূপেও পানি উঠছে না। এতে শুধু সেচকাজই নয়, কৃষকদের দনন্দিন পানির চাহিদা মেটানোও কষ্টকর হয়ে পড়ছে। মূলত অধিক পানি ব্যবহার করে ধান চাষের প্রতি জোর দিতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কট চরম আকার ধারণ করছে। পানি সঙ্কটের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা ধান চাষ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষিমন্ত্রীও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পাতকুয়া ও ইঁদারা। অতীতে গ্রামবাংলায় পানীয়জল প্রাপ্তির একমাত্র অবলম্বন ছিল এগুলো। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে ধীরে ধীরে মানুষের জীবনে আসতে থাকে পরিবর্তন। ইঁন্দারা ও কুয়ার স্থান দখল করে নেয় গভীর ও অগভীর নলকূপ। সচেতন মানুষ ক্রমাগত সরে আসতে থাকে প্রাচীন প্রযুক্তি থেকে নতুন প্রযুক্তিতে। তবে কিছু কিছু গ্রামীণ এলাকায় পাতকুয়া ও ইঁন্দারা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। সেই পাতকুয়াই এখন দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধানে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। অবশ্য একটু প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এ পাতকুয়াই ওই অঞ্চলে পানীয়জল এবং সীমিত আকারে সবজি চাষে সেচের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের মৃত্তিকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চল একটি বিশেষ মৃত্তিকা অঞ্চল। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর মোটেই সমৃদ্ধ নয়। বিশেষ করে ঠা ঠা বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতই অনুন্নত যে, তা গভীর নলকূপ বা অগভীর নলকূপ দিয়েও উত্তোলন সম্ভব হয় না। তবে এসব এলাকায় পাতকুয়া খনন করলে কুয়ায় পানি জমে। কুয়ায় জমা পানি উত্তোলন করে খাবার পানি ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারসহ কম সেচ লাগে এরূপ ফসল চাষ করা সম্ভব। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর, নাচোল এবং নওগাঁ জেলার সাপাহার, পোরসা, পত্মীতলা ও নিয়ামতপুর উপজেলা ঠা ঠা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে পরিচিত। এসব উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় পানির স্তর অত্যন্ত নিচে। ভূগর্ভস্থ স্তরের গঠন প্রকৃতির কারণে এলাকায় কোন নলকূপ বসানো যায় না। অপেক্ষাকৃত রুক্ষ আবহাওয়া, উচ্চ তাপমাত্রা, স্বল্প বৃষ্টিপাত ও ভূউপরিস্থ পানির স্বল্পতা এ এলাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ সময় এ বিরাট আবাদযোগ্য এলাকা পতিত থাকে। এ অঞ্চলের মানুষ এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল। তাও আবার কোন বছর বৃষ্টিপাত না হলে পানির অভাবে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এসব এলাকার লোকজন গৃহস্থালি কাজের জন্য বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা ও খালের পানি ব্যবহার করে, যা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। খাবার পানির জন্য এক-দুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে। এলাকাবাসীর এ দুর্দশা অনুধাবন করে কৃষিমন্ত্রীর পরামর্শে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পাতকুয়া খননের উদ্যোগ নেয়। এখন এ পাতকুয়া থেকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে কম সেচযোগ্য ফসল আবাদে সেচ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি খাবার পানি ও গৃহস্থালি কাজে এ কুয়ার পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, সন্তোষজনক পানি পাওয়ার জন্য প্রায় ৪৬ ইঞ্চি ব্যাসের এক শ’ বিশ থেকে ত্রিশ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করা প্রয়োজন হয়। বরেন্দ্র এলাকায় আদিবাসী লোকজন এ ধরনের পাতকুয়া তৈরি করতে অসমর্থ হওয়ায় তারা খুব কষ্টে জীবনধারণ করে এবং তাদের জমিতে কোন ফসল ফলাতে পারে না। বিষয়টি উপলব্ধি করে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর পরামর্শে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঠা ঠা বরেন্দ্র এলাকায় পরীক্ষামূলক পাতকুয়া খনন কার্যক্রম শুরু করে। কুয়ার অনেক নিচে থেকে প্রচলিত পদ্ধতিতে দড়ি-বালতি ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করা বেশ কষ্টসাধ্য। তাই এ অসুবিধা দূর করার জন্য প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগিয়ে পাতকুয়া থেকে পানি উত্তোলন পদ্ধতি আধুনিক করা হয়েছে। এর সঙ্গে সোলার প্যানেল, পানির পাম্প ও পাইপ ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সোলার প্যানেলগুলো প্রচলিত লম্বা সারিতে ব্যবহার না করে কৃষিমন্ত্রীর পরামর্শে কিছুটা ফানেল আকৃতি করে স্থাপন করা হয়, যাতে বৃষ্টির পানি জমে কুয়ায় পতিত হয়। এটি কৃষিমন্ত্রীর একটি বিশেষ উদ্ভাবন। পাতকুয়ায় জমা হওয়া পানি সাবমারসিবল সোলার পাম্প ব্যবহার করে কুয়ার উপরে স্থাপিত ট্যাঙ্কিতে জমা করা হয়। ট্যাঙ্কিতে জমাকৃত পানি পিভিসি পাইপলাইনের মাধ্যমে পাতকুয়ার কাছেই স্থাপিত ট্যাপ হতে জনসাধারণ পান করা ও গৃহস্থালির কাজের জন্য সংগ্রহ করে। সেই সঙ্গে চাষযোগ্য জমিতে পাইপলাইন নির্মাণ ও বিভিন্ন স্থানে ফসেট বা আউটলেট স্থাপন করে তা থেকে সরাসরি ও ফিতা পাইপের মাধ্যমে সেচের পানি ব্যবহার করা হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কর্তৃক ইতোমধ্যে খননকৃত ছয়টি পাতকুয়ার কার্যক্রম বর্তমানে সোলার পাম্পের সাহায্যে পরিচালনা করা হচ্ছে। উপকারভোগী লোকজন পাতকুয়ার পানি খাবার পানি হিসেবে পান ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও কম সেচ লাগে এমন সব ফসল যেমন- আলু, পটল, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শসা, বেগুন, শিম, লাউ, ছোলা, মসুর ইত্যাদি চাষ করে লাভবান হচ্ছে। নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার দিবার ইউনিয়নের চক সহবত মৌজায় এমনই একটি পাতকুয়া খনন করা হয়েছে। এ পাতকুয়ার গভীরতা ৬০ ফুট এবং ডায়া ৪৬ ইঞ্চি। এ পাতকুয়াটিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সুযোগ রেখে পানের আকৃতির সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। এ পাতকুয়া থেকে ৫০০ ওয়াট ক্ষমতার সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে ওভারহেড ট্যাঙ্কে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এ পানি ১৮শ’ ফুট পাইপ নালার মাধ্যমে ৮ একর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে, যা দিয়ে কম সেচের প্রয়োজন এমন ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। ফসলের মধ্যে রয়েছেÑ শিম, লাউ, ঢেঁড়স, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, পুঁইশাক, পালংশাক, লালশাক, করলা, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, গম ও ছোলা। বিএমডিএ কর্মকর্তারা জানান, সারাদিন সেচ দেয়ার ফলে কুপের যে পরিমাণ পানি নিচে চলে যায়, পরের দিন সকালবেলা দেখা যায় কুয়ার পানির ‘লেভেল’ আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। কৃষকরা জানান, এটি মরুভূমি এলাকা। পানির অভাবে এ এলাকায় কোন ফসল হচ্ছিল না। এখন বরেন্দ্র তাদের পাতকুয়া দিয়েছে। দিয়েছে অটো সোলার। এখন তারা ওই কুয়া থেকে পানি ব্যবহার করতে পারছেন। ফলে তারা সারাবছর শাকসবজি খেতে পারছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মোঃ নাসিরুজ্জামান বলেন, পাতকুয়াগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির আধার হিসেবেও কাজ করছে। এসব পাতকুয়ায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত হচ্ছে এবং খুব সামান্য পানির প্রয়োজন হয়। এ ধরনের ফসল উৎপাদন করায় পানির মিতব্যয়ী ব্যবহার হচ্ছে। ফলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তিনি জানান, ইতোমধ্যে ‘বরেন্দ্র এলাকায় পাতকুয়া খননের মাধ্যমে স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হচ্ছে পাতকুয়া খননের মাধ্যমে সংরক্ষিত পানি দিয়ে স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন ও খাবার পানিসহ গৃহস্থালি কাজে পানি সরবরাহ। ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের নয়টি উপজেলায় ৪৫০টি পাতকুয়া নির্মাণ করা হবে। জানা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী বিভাগের ঠা ঠা বরেন্দ্র এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তিনটি (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, গোমস্তাপুর ও নাচোল) এবং নওগাঁ জেলার ছয়টি (নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পতœীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার ও পোরশা) মোট ৯টি উপজেলায় ৪৫০টি পাতকুয়া খনন করা হবে। এতে ওই এলাকার ১৩৫০ হেক্টর জমিতে স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে উপজেলাগুলোর ১৯৭টি গ্রামের ৩৩ হাজার ৭৫০ জন মানুষকে খাবার ও গৃহস্থালির কাজে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
×